একটু ভেবে নিতেই বুদ্ধিমান ডোডোবাবু ব্যাপারটা বুঝলেন, বললেন, তার মানে পড়ে পাওয়া চৌদ্দ আনা। এবার এ কথার নিহিতার্থ ধরে ফেলতে তিনি রাগে ফুসতে লাগলেন। মেমসাহেবকে বললেন, তা হলে ব্যাপারটা হল, আপনার কলকাতায় শ্বশুরবাড়িতে আসা হল পড়ে পাওয়া চৌদ্দ আনা। আপনি ভাবেন কী?
তাতাইবাবু মধ্যস্থতা করে বললেন, আপনার মেমবউদি বাংলা কিছু বোঝেন না। ওঁকে এসব কথা বলে কোনও লাভ নেই।
ডোডোবাবু উত্তেজিত হয়ে বললেন, তা হলে এই সব আপনি মুখস্থ করিয়েছেন মেমকে দিয়ে আর উনি কিছুই না বুঝে ঝরঝর করে বলে যাচ্ছেন।
বছর কুড়ি-পঁচিশ আগে হলে এতক্ষণে ডোডোবাবু আর তাতাইবাবুর মধ্যে হাতাহাতি হয়ে যেত।
এ বার অবশ্য তা হল না। ডোডোবাবুর কোথায় একটা কাজ ছিল, তিনি তাড়াতাড়ি চলে গেলেন, বলে গেলেন দুয়েকদিনের মধ্যেই আসছেন। বেরোনোর সময় সদর দরজা চৌকাঠের ওপরে তাতাইবাবু ডোডোবাবু মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, মেমবউ ঠিক মধ্যিখানে এসে দাঁড়ালেন। তার পর দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে দুজনকে বার দুয়েক ভাল করে দেখে কোনও রকম দ্বিধা না করে মেমসাহেব ডোডোবাবুকে বললেন, তুমি যেমন বুনো তেঁতুল আর ইনি তেমনই বাঘা ওল, বলে তাতাইবাবুকে দেখালেন।
আধকপালে
সকলেই কেমন ভাল ভাল গল্প লেখে। প্রেমের, ভালবাসার, বিরহ-বিচ্ছেদের গল্প। জীবনের জয় পরাজয়, বাঁচার লড়াইয়ের গল্প। কত আর্থসামাজিক প্রশ্ন। বর্তমানের সমস্যাবলি সেই সব গল্পের মধ্যে ফুটে ওঠে।
সুখ-দুঃখের নিটোল গল্প সেসব। তার মধ্যে পাত্র-পাত্রী, চরিত্রাবলি রয়েছে, কথোপকথন অর্থাৎ চোখা চোখা লাগসই সব ডায়ালগ আছে। সব চেয়ে বড় কথা সেখানে কাহিনি আছে। সেই কাহিনির গতি আছে। পরিণতি আছে।
আমার গল্পগুলো কিছুতেই কেন যেন, সেরকম হয় না। হাজার চেষ্টা করলেও না। কী রকম ন্যালাখ্যাপা, উলটোপালটা গল্প হয়ে যায় আমার। সেগুলোর কারণ নেই, কাহিনি নেই শুধু ফ্যা-ফ্যা করে হাসি। কেন যে দয়ালু পাঠক, দয়াবতী পাঠিকা সেই হাঘরে গল্প পড়েন, কেন যে সম্পাদক মহোদয় অনুগ্রহ বশত সেই ফাপা গল্প ছাপেন, সেটা আমি যেমন বুঝতে পারি না, আরও অনেকেই পারেন না। এমনকী আমার স্ত্রী পর্যন্ত পারেন না।
বারো হাত কাঁকুড়ের তেরো হাত বিচির মতো একটা যৎকিঞ্চিৎ গল্পে তিন অনুচ্ছেদ ভূমিকা ফেঁদে বসার পরে খেয়াল হল যে এরকম ভাবে কালক্ষেপণ করা উচিত হচ্ছে না কারণ আমাদের বর্তমান কাহিনির নায়কের আধকপালে হয়েছে। তাঁকে বেশিক্ষণ ঝুলিয়ে রাখা উচিত হবে না।
আমাদের এই কাহিনির নায়কের নাম সুদর্শন পাল। সুদর্শনের আধকপালে হয়েছে।
আধকপালে ব্যাপারটা যাঁরা জানেন না তাদের বোঝানোর চেষ্টা করব না। তবে যেটা আশঙ্কা করেছিলাম যে এই আজব শব্দটি কোনও অভিধানেই থাকবে না, সেটা ঠিক নয়। শব্দটি দেখছি সব অভিধানেই রয়েছে, খুব সম্ভব অভিধানকারেরা সঙ্গত কারণেই এই আধকপালে ব্যারামে খুব ভোগেন, সে জন্যেই শব্দটি অভিধানে চলে গেছে।
অভিধানের কথাই যখন উঠল, আগে আধকপালে শব্দটার অভিধানগত মানেটা দেখে নিই। চলন্তিকায় আধকপালে মানে রয়েছে এক দিকে মাথা ধরা। আর সংসদ বিস্তারিত করে বলেছেন, অর্ধেক বা আংশিক মাথা বা কপাল জুড়িয়া আছে এমন মাথাধরা।
আধকপালে খুব গোলমেলে ব্যারাম। সহজে সারতে চায় না। মাথার একদিকে বাঁয়ে বা ডাইনে একটা মাথাধরা সদাসর্বদা লুকিয়ে থাকে। কিছুতে যেতে চায় না। সারা দিনমান ধরে খুব কষ্ট দেয়। সেই সকালে ঘুম থেকে উঠে রাতে শোয়া পর্যন্ত যন্ত্রণা, কখনও কম, কখনও বেশি।
কিন্তু আমাদের এই কাহিনির নায়ক সুদর্শনবাবুর আধকপালে অসুখটা অভ্যেস হয়ে গেছে। তিনি প্রায় বছরখানেক ধরে এই অসুখে ভুগছেন। প্রথম প্রথম খুব কষ্ট, খাওয়া-পরা, অফিস-কাছারি করা, টিভি দেখা, খবরের কাগজ পড়া, সব কিছুতেই কষ্ট হত। সব সময় মাথার মধ্যে একটা যন্ত্রণা। কপালের বাঁদিক ঘেঁষে একটা অসহ্য টনটনানি। অডিকলোনের পট্টি কপালে দিলে দরজা জানলা বন্ধ করে চোখ বুজে অন্ধকার ঘরে শুয়ে থাকলে একটু আরাম হত।
মাথা ধরাটা এখনও সব সময়ই মাথার মধ্যে আছে, কিন্তু ব্যাপারটা সহ্য হয়ে গেছে সুদর্শনবাবুর। মাথায় একটু ঝাঁকি লাগলেই যন্ত্রণাটা চিড়িক দিয়ে ওঠে, তা ছাড়া অন্য সময়ে তেমন কষ্ট হয় না। কোনও রকমে কাজকর্ম, দিনগত পাপক্ষয় করে যাওয়া যায়। ব্যথাটা থাকলেও জানান দেয় না।
গত বছরের গোড়ায় যখন প্রথম আধকপালে হল সুদর্শনবাবুর, তিনি দু-চারবার পাড়ার ডাক্তারের কাছে যাতায়াত করে অবশেষে একশো টাকা ভিজিটের বড় ডাক্তার দেখিয়েছিলেন। বড় ডাক্তার নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা, মেডিকেল টেস্ট করেও যখন অসুখটার প্রকৃত কারণ নিরূপণ করতে পারলেন না, তিনি সুদর্শনবাবুকে বললেন, সরি, আপনার অসুখটা সহজে সারবে না। ওষুধপত্র খেয়ে কিছু সুরাহা হবে বলে মনে হয় না। অপেক্ষা করে দেখুন। একা একা সেরে যায় কিনা।
কালক্রমে অসুখটা সম্পূর্ণ সেরে যায়নি বটে, তবে তার দাপট অনেকটা কমেছে। সুদর্শনবাবু টের পান যন্ত্রণাটা মাথার মধ্যেই কোথাও লুকিয়ে আছে, মাথা নড়া-চড়া করলে, বিশেষ করে জোরে হাসলে মাথায় লাগে। তা ছাড়া মালুম হয় না।
সম্প্রতি কয়েক সপ্তাহ আগে সেই বড় ডাক্তারবাবুর কাছে আবার গিয়েছিলেন সুদর্শনবাবু। আরেকবার একশো টাকা ভিজিট দিয়ে দেখালেন। সব শুনে ডাক্তারবাবু বললেন, তাহলে তো এখন আর আপনার কষ্ট নেই।