ঘণ্টা খানেক পরে রাগে গরগর করতে করতে, আমার টেবিলের ওপরে রাখা শ্ৰীযুক্তেশ্বরী ডায়ানার আবক্ষ চিত্র-সম্বলিত সেদিনের দৈনিক পত্রিকাটি কুটি কুটি করে ছিঁড়ে চিরঞ্জীববাবু নিষ্ক্রান্ত হলেন।
এর পরে আরও আধ ঘণ্টা বনবিহারীবাবু কোনও কথা না বলে মাথায় হাত দিয়ে চুপ করে বসে রইলেন। শুধু যাওয়ার আগে একবার ক্ষীণ প্রশ্ন করলেন, ডায়না কি দোষী? তিনি কি কুলটা?আমি কিছু বললাম না। কী বলব?
যাওয়ার সময়ে বনবিহারীবাবু বলে গেলেন, দেখুন আপনি সমস্ত বিষয়ে এত খবর রাখেন, আপনার সঙ্গে আলোচনা করে এত উপকার হয়, আপনাকে ধন্যবাদ জানানোর ভাষা আমার জানা নেই।
আমি কী আলোচনা করলাম, কখন করলাম, কিছুই বুঝতে পারলাম না।
আবার জীবনে উত্তেজনা ফিরে আসছে।
সকালে হাঁটা আবার শুরু করেছি। টগবগ করতে করতে বাড়ি ফিরে আসি। ফিরে এসে কিংবা পরে দুপুরে কিংবা সন্ধ্যায় কখনও বনবিহারীবাবু, কখনও চিরঞ্জীববাবু, কখনও বা দুজনেই একসঙ্গে আসেন। আমি কিছু বলি বা না বলি, যাওয়ার সময়ে আমার সুচিন্তিত মতামতের জন্যে তারা ধন্যবাদ জানাতে ভোলেন না।
অবিচ্ছিন্ন
সেই কবেকার ডোডোতোতাই। তারা এখন আর সেই ছয়-সাত বছরে আটকিয়ে নেই, ঢের বড় হয়েছে।
তাতাইবাবু এখন বিদেশবাসী। সেখানে পড়াশুনো শেষ করে এখন নিজেই পড়াচ্ছেন। আর ডোডোবাবু পুরোদস্তুর এঞ্জিনিয়ার, তাকেও কাজেকর্মে প্রায়ই বিদেশে যেতে হয়।
প্রায় আড়াই বছর পরে এবার তাতাইবাবু কলকাতায় এসেছিলেন। সঙ্গে মেমবউ, বিশাল বড়সড় মেমসাহেব। তাতাইয়ের কাকা বউ দেখে বলেন, এই একটা বউ একাই চারটে বউয়ের সমান, বাড়ি ভরে গেছে।
তাতাইবাবু কিন্তু একদম বদলাননি। প্রথম দিন এসেই দশ বারোটা কঁচা জলপাই নুন দিয়ে খেয়ে ফেললেন। জলপাইগুলো বাজার থেকে আনা হয়েছিল চাটনি করার জন্যে। তাতাইবাবুর গোগ্রাসে জলপাই খাওয়া দেখে তাতাইবাবুর মা হায়-হায় করে উঠলেন। তাতাইবাবু বললেন, ভয় পেয়ো না। কিছু হবে না।তাতাইবাবুর মা বললেন, চাটনিও হবে না। এই শুনে তাতাইবাবুর কাকা সাইকেল নিয়ে বেরোলেন আবার জলপাই কিনে আনতে।
তাতাইবাবুর মা খুব চিন্তা করেন, বউয়ের সঙ্গে আমি তো ইংরেজিতে কথা বলতে পারব না।
তাতাইবাবু বলেন, পারবে না কেন?
বউয়ের উচ্চারণ তো আমি কিছুই ধরতে পারি না।তাতাইবাবুর মা কবুল করেন।
সে ভেবো না।তাতাইবাবু আশ্বাস দেন, আমি ওকে চটপট বাংলা শিখিয়ে দিচ্ছি।
শুরু হল মেমবউকে বাংলা শেখানো। প্রথমে লেখাপড়া নয়, কথাবার্তা বলা। তাতাইবাবুর ইচ্ছে চমকপ্রদ কিছু বাক্য শিখিয়ে সবাইকে বিস্মিত করে দেওয়া।
ইতিমধ্যে কয়েকদিন বাদে তাতাইবাবুর আসার খবর পেয়ে ডোডোবাবু এলেন। ডোডোবাবু ছিলেন কুয়ালালামপুরে, সেখানে ব্রিজ বানাচ্ছেন। কাজের ছুটিতে তিনি তাতাইবাবুর সঙ্গে দেখা করতে এলেন।
ডোডোবাবু কুয়ালালামপুরে কী কাজ করছেন শুনে তাতাইবাবু বললেন, ওখানে সাঁকো বানাচ্ছেন কেন, আমাদের দেশে কি সাঁকো বেশি হয়ে গেছে?
সঙ্গে সঙ্গে ডোডোবাবু পালটা প্রশ্ন করলেন, আপনিই-বা বাইরে কী পড়াচ্ছেন, আমাদের দেশে কি ছাত্র কম পড়ে গেছে?
প্রায় পুরনো দিনের মতো বাদ-বিসম্বাদ শুরু হয়ে যায় আর কী এমন সময় ডোডোবাবু এসেছেন শুনে বাইরের ঘরে তাতাইবাবুর মেমবউ এলেন। তাতাইবাবুর কাছে ডোডোবাবুর কথা তিনি অনেক শুনেছেন।
ডোডোবাবু ঝাড়া পৌনে ছয় ফুট লম্বা। ডোডোবাবু দেখলেন, তাতাইবাবুর বউ বোধ হয় তার চেয়েও লম্বা। বিস্ময়ের ভাবটা কেটে যেতে ডোডোবাবু পকেট থেকে একটা চকোলেটের বার বের করে মেমবউকে দিলেন।
মেমবউ হাসিমুখে সেটা হাতে নিয়ে ভাঙা বাংলায় বললেন, এখন খাওয়া আছে না। এখন লুচি পায়েস খেয়েছি। পেটে ছুঁচো ডন দিচ্ছে।
মেমসাহেবের কথা শুনে ডোডোবাবু অবাক হয়ে তাতাইবাবুর দিকে তাকালেন, তাতাইবাবু বললেন, আমি ওকে বাংলা বলা শেখাচ্ছি।
ডোডোবাবু বললেন, কিন্তু এসব কী শেখাচ্ছেন? খিদে লাগলে পেটে ছুঁচোয় ডন দেয়, ভরা পেটে ছুঁচো ডন দিতে যাবে কেন?
তাতাইবাবু কিছু বলার আগে মেমসাহেব ভুলটা অনুমান করতে পেরে বললেন, ওই একই কথা, যা ফিফটি থ্রি তাই ফিফটি টু।
ডোডোবাবু এবার তাতাইবাবুকে চেপে ধরলেন, এসব ওঁকে কী শেখাচ্ছেন।
তাতাইবাবুদের বাড়ির পুরনো রান্নার মহিলা তাকে তাতাইবাবু মাসি বলেন, মেমবউও মাসি বলছেন। সেই মাসি এর মধ্যে ডোডোবাবু এসেছেন শুনে নালিশ জানিয়ে গেলেন, আজ সকালে বউ আমাকে বরের ঘরের পিসি কনের ঘরের মাসি বলেছে।
ডোডোবাবু বুঝলেন ব্যাপার গুরুতর। তাতাইবাবুর মা-ও বললেন পুরো অবস্থা খুব জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং তিনি এই জন্যে তাতাইবাবুকেই দোষী সাব্যস্ত করলেন।
কিন্তু কী আর করা যাবে মেমসাহেব তখন গড়গড় বলে চলেছেন, রীতিমতো প্রশ্নের ভঙ্গিতে, রাতে মাছি, দিনে মশা, এই জন্যে কলকাতায় আসা?
কলকাতা বিষয়ে এরকম কথা বলায় ডোডোবাবু খুব চটে গেলেন, তিনি সামাজিকতার ধার না ধরে কড়া ভাবে বললেন, এলেন কেন?
মেমবউ তখন প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাতাইবাবুর দিকে তাকাতে তিনি ডোডোবাবুর মন্তব্যটা ইংরেজিতে অনুবাদ করে দিলেন, সঙ্গে সঙ্গে মেমবউ বললেন, পড়ে পাওয়া সাতাশি পয়সা।
তার মানে? ডোডোবাবু অবাক হয়ে তাতাইবাবুর কাছে জানতে চাইলেন। তাতাইবাবু বললেন, সাতাশি পয়সা বুঝলেন না, সেই পুরনো চৌদ্দ আনা।