কিন্তু আমি তো অসামাজিক জীব নই। চিরকাল সকলের সঙ্গে মেলামেশা করে চলতে ভালবাসি। সুতরাং নতুন পরিচয় হতে লাগল।
চিরঞ্জীববাবুর সঙ্গে পরিচয় হল। তাঁর কাছে আমি একটা নতুন হিসেব পেলাম। জীবনের এ হিসেবটা এর আগে ভাবিনি।
চিরঞ্জীববাবু থুরথুরে বুড়ো। বাইশ বছরের পেনশনার। চাকরিতে ঢুকেছিলেন অভঙ্গ বঙ্গের মুসলিম লিগ আমলে, ইংরেজের যুগে। পুলিশের দারোগা হয়ে ঢুকে ছোট সাহেব হয়ে বিদায় নিয়েছিলেন।
সাধারণত পুলিশের লোকেরা রিটায়ার করার পরে কখনও বলতে চান না পুলিশের চাকরি করতেন, বড় জোর বলেন, সরকারি কাজ করতাম। সেই জন্যে বাড়ির নেমপ্লেটে অবসরপ্রাপ্ত হেডমাস্টার থেকে মেডিকেল কলেজের প্রাক্তন সার্জন, কৃষি বিভাগের উপ অধিকর্তা লেখা থাকে কিন্তু অবসরপ্রাপ্ত আই পি এস বা পুলিশের ডেপুটি সুপার কিংবা দারোগা–এসব দেখতে পাওয়া যায় না।
চিরঞ্জীববাবু অবশ্য উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। তিনি নিজে যেচে এসে আলাপ করেছিলেন। একদিন কথাপ্রসঙ্গে তার প্রতিবেশিনী এক দুশ্চরিত্রা মহিলার উল্লেখ করে নিজের অক্ষমতার কথা বলে জানলেন, চাকরির প্রথম জীবনে বড়তলা থানার দারোগা ছিলাম, প্রচুর বেশ্যা পিটিয়েছি।
তাঁর কথা শুনে আমি আঁতকিয়ে উঠলাম, বললাম, নতুন যুগ। ভেবেচিন্তে ভালভাবে কথা বলুম। বলুন, প্রচুর যৌনকর্মীকে নিপীড়ন করেছি।
চিরঞ্জীববাবু মাথা নেড়ে বললেন, না মশায়। পুলিশে কাজ করলে কী হবে আমার স্বভাবচরিত্র খারাপ ছিল না। নিপীড়ন-টিপীড়ন নয়, কর্ম-কর্ম করিনি, স্রেফ পিটিয়েছি।
এই চিরঞ্জীববাবুই আমাকে বুঝিয়েছিলেন, আমি দুগ্ধপোষ্য, নাবালক। নিতান্তই জুনিয়র, এক বছরও হয়নি রিটায়ার করেছি। রিটায়ারদের মধ্যে পর্যন্ত সিনিয়ারিটি আছে। কী চাকরি ছিল, কত বড় চাকরি তা নয়। কতদিন হল রিটায়ারের পর সেটাই একমাত্র বিবেচ্য। এর পরে প্রমোশন পরলোকে। তবে যমরাজা এই সিনিয়রিটি খুব একটা মর্যাদা দেন বলে মনে হয় না।
আমি বললাম, যমরাজের কাছে এ বিষয়ে একটা ডেপুটেশন দিলে হয় না। তিনি আমার এই প্রস্তাবে খুব একটা গুরুত্ব দিলেন না।
চিরঞ্জীববাবুর সঙ্গেই একদিন এসেছিলেন বনবিহারীবাবু। সার্থক নাম রেখেছিলেন তাঁর গুরুজনেরা। তিনি বনদপ্তরে দীর্ঘ সাঁইত্রিশ বছর কাজ করেছিলেন।
বনবিহারীবাবু চিরঞ্জীববাবুর থেকে বছর পাঁচেকের জুনিয়র। তিনি কেমন থপথপ করে হাঁটেন। এমনিতে শরীর-স্বাস্থ্য বেশ ভাল। লাঠি ব্যবহার করেন না, আজকাল কেই বা করে। কিন্তু বনবিহারী যখন হেঁটে আসেন, দূর থেকে মনে হয় তিন পায়ে হেঁটে আসছেন। তার একটা বড় কারণ অবশ্য তার আভূমিলম্বিত দীর্ঘ কোঁচা। তিনি এখনও সামান্য সংখ্যক ধুতিপরিয়েদের দলে।
বনবিহারীবাবুর প্রধান গুণ কৌতূহল এবং অনুসন্ধিৎসা। এই বয়েসেও সব বিষয়ে, বিশেষ করে খবরের কাগজের প্রথম পাতায় যেসব মোটা খবর বেরোয়, সেই সব নিয়ে তাঁর নানা প্রশ্ন।
সম্প্রতি গণেশ ঠাকুরের দুধ পানের সময় এবং এর পিঠোপিঠি পূর্ণ সূর্যগ্রহণের সময় বনবিহারীবাবু আমাকে খুব অত্যাচার করেছেন। দুগ্ধ পানের মহাদিনের পরের দিন সকালে বনবিহারীবাবু এসে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি তো কিছুদিন এলগিন রোডে ছিলেন?
আমি বললাম, ঠিক এলগিন রোডে নয়, কাছেই গোখেল রোডে বছর দেড়েক ছিলাম এক সময়ে।
বনবিহারীবাবু প্রশ্ন করলেন, আপনি কি শুনেছেন ওই গোখেল রোডের মোড়ের লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দিরের গণেশ ঠাকুর ফার্স্ট হয়েছে। আমি অবাক হয়ে বললাম, ফার্স্ট হয়েছে? মানে?
বনবিহারীবাবু বললেন, লোকেরা বলছে ওই গণেশটাই সবচেয়ে বেশি দুধ খেয়েছে। ডানকুনি থেকে মাদার ডেয়ারি স্পেশ্যাল এক গাড়ি দুধ পাঠিয়েছিল।
আমি বললাম, তা কী করে হয়?
কিন্তু সূর্যগ্রহণের সময় এত সহজে পরিত্রাণ পাইনি। গ্রহণের আগের দিন এসে বললেন, জানেন গ্রহণের সময় ভেড়ারা ঘাস খায় না। কাগজে বেরিয়েছে।
আমি জানতাম না, চুপ করে রইলাম। কিন্তু বনবিহারীবাবু চুপ করে থাকার লোক নন। কিছুক্ষণ ধরে বার বার বলে যেতে লাগলেন, ভেড়ারা পর্যন্ত গ্রহণ চলাকালীন ঘাস মুখে দেয় না, আমাদের কি কিছু খাওয়া উচিত?
বনবিহারীবাবুর অবশ্য একটা গুণ অস্বীকার করা অনুচিত। তিনি শুধু প্রশ্নই করেন উত্তর আশা করেন না। আমি একটি কথা না বললেও চলে যাওয়ার সময়ে বলে যান, আপনার সঙ্গে আলোচনা করে মাথাটা পরিষ্কার হয়ে গেল। আপনার সঙ্গে কথা বলেও সুখ।
আমি বুঝতে পারছিলাম, এ সুখ আমার বেশিদিন সইবে না।
এ দিকে চিরঞ্জীববাবু বনবিহারীবাবুকে আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে কেটে পড়েছেন। আজকাল কালেভদ্রে আসেন। সেও বনবিহারীবাবুকে দেখলে কোনও অজুহাতে কেটে পড়েন।
সে দিন হঠাৎ দুজনে আবার এক সঙ্গে এলেন। দেখলাম দুজনেই বেশ উত্তেজিত, বিষয় যুবরানি ডায়ানা। আমার ঘরে ঢুকেই চিরঞ্জীববাবু বললেন, তার যৌবন বয়সে ওই মহিলাকে বড়তলা থানা এলাকায় পেলে তিনি পিটিয়ে তক্তা করে দিতেন। বিপথগামিনী রমণীদের ওপর তার খুব রাগ; তদুপরি তিনি ইংরেজ আমলের রাজভক্ত পুলিশ, রাজ পরিবারের অবমাননা তিনি দেখতে পারেন না।
দুই বৃদ্ধের মধ্যে খটাখটি শুরু হয়ে গেল। চিরঞ্জীববাবু রাজপুত্রের পক্ষে আর বনবিহারীবাবু রাজবধূর পক্ষে। উৎকট চেঁচামেচি, প্রায় হাতাহাতি। বাড়িটা যে আমার, আমি যে ঘরের মধ্যে জলজ্যান্ত একজন তৃতীয় ব্যক্তি বসে আছি, সেটা কারও হুশ হল না। সুদূর ব্রিটেনের রাজ পরিবারের ঘরোয়া কলহে আমার বৈঠকখানা ঘর গমগম করতে লাগল।