শেষ দিকে নিকট বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে যে খুব ঘন ঘন দেখাশোনা হত, আড্ডা হত তা তো নয়। কিন্তু মনে মনে স্বস্তি পেতাম এই ভেবে যে সবাই কাছাকাছি আছে। একটা কেমন নিরাপত্তাবোধ ছিল, এক ডাকে দশ-বিশটা চেনাজানা আপন লোক দৌড়ে আসবে।
তা নয়, এ যে কোথায় চলে এলাম। উড়ো উড়ো, কঁকা ফাঁকা নতুন গড়ে ওঠা এই শহরতলিতে আমি যেন কেমন বেমানান। যেন থাকতে আসিনি, বেড়াতে এসেছি।
তবুও মোটামুটি নতুন বাসায় এসে থিতু হয়ে বসেছি।
বাসা বদলের ঝামেলা অনেক। রেশন কার্ড, গ্যাস, ইলেকট্রিক মিটার, টেলিফোন এমনকী কাজের লোক, মুদির দোকান এই সব এক ধাক্কায় বদলানো সোজা কথা নয়। কত রকম দৌড়-ঝাঁপ, তদ্বির-তদারক। এই বয়েসের পক্ষে যথেষ্টই হ্যাঁপা।
তবু মাসদুয়েকের মধ্যে প্রায় সব কিছুই সড়গড় হয়ে এসেছে। মোটামুটিভাবে বলতে পারি, ভাল আছি, ভালই আছি। এতটা ভাল থাকব, ভাবিনি। একটা নতুন রুটিনে ক্রমশ অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি। তেমন ধরাবাঁধা কিছু ব্যাপার নয়, ঢিলেঢালা একটা জীবন।
কিন্তু সম্পাদকমশায়, এ তো মোটেই গল্প হচ্ছে না। জনৈক অবসরপ্রাপ্ত প্রৌঢ়ের আত্মবিলাপ কিংবা বড় বাবুর পরিণাম নামে এরকম রচনা আপনার পত্রিকায় না হলেও ছোট-মাঝারি কাগজে প্রকাশিত হতে পারে।
কিন্তু সম্পাদকমশায়, আমি তো পাকা গল্প লিখিয়ে। আপনার কাগজেই এ যাবৎ অন্তত পঞ্চাশটা গল্প লিখেছি। এমন কোনও পুজোসংখ্যা আছে যেখানে আমি প্রত্যেক বছর গল্প লিখি না।
কিন্তু সম্পাদকমশায়, আপনি আমার সুহৃদ না হতে পারেন আপনি অবশ্যই আমার শুভানুধ্যায়ী। আপনি কত কিছু নিয়ে ভাবেন। আমাকে নিয়েও একটু ভাবুন। আমার এমন অবস্থা কেন হল? সে কি শুধু চাকরি খতম, বাসা বদল বলে?
সে যা হোক, এবার ধারাবিবরণীতে ফিরে যাই। আগে সকালবেলায় প্রথম কাজ ছিল হাঁটা। ভোরবেলায় উঠে হাতমুখ ধুয়ে হাঁটতে বেরোতাম। যখন যে পাড়ায় থেকেছি, সেই রকম হেঁটেছি। কখনও ফুটপাথ ধরে সকালবেলায় খালি রাস্তায় হেঁটেছি, কখনও বাড়ির কাছের পার্কে বা স্কোয়ারে। দশ-বারো বছর লেকের চারপাশে হেঁটেছি। কাছাকাছি থাকার সুবাদে বছর দশেক ময়দানেও হেঁটেছি।
মর্নিং ওয়াক কিন্তু শুধু ওয়াক নয়। এটা এক ধরনের মর্নিং ক্লাব। বহু লোকের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ হয়, পরিচয় ঘঠে। নানা রকম যোগাযোগ, তথ্য ও অভিজ্ঞতা বিনিময় হয়। একটু হাসি-ঠাট্টাও হয়।
এখানে এসেও, বাসা গুছিয়ে নেওয়ার পরে, দিন পনেরো বাদে হাঁটতে বেরিয়েছিলাম। পুরনো অভ্যাস যাবে কোথায়?
তা ছাড়া এই নতুন অঞ্চলটা হাঁটার পক্ষে অনুপম। রাস্তাঘাট ফাঁকা, মোটামুটি পরিষ্কার। আলো-বাতাস সুপ্রচুর। পরিবেশ দূষণ তুলনামূলকভাবে কম।
প্রথম দিন হাঁটতে বেরিয়েই যাঁদের সঙ্গে দেখা হল তাদের মধ্যে অনেকেই আমার পূর্ব-পরিচিত। তাদের সঙ্গে কখনও দেখা হবে ভাবিনি। কারও কারও সঙ্গে বা অধীনে আমি একসময় কাজ করেছি। তাদের কথা কবে ভুলে গিয়েছিলাম, এমনকী তারা যে এখনও আছেন তা পর্যন্ত কখনও ভাবিনি।
তাঁদের অনেককে এক সঙ্গে দেখে আমি সেই আলো-আঁধারি ভোরবেলায় কেমন বিচলিত হয়েছিলাম, তারাও তেমনই উল্লসিত হয়েছিলেন।
আদিত্যবাবু। এঁর সঙ্গে বছর তিনেক কাজ করেছিলাম, আমাকে দেখে এগিয়ে এসে বললেন, এই তারাপদ, তুমিও তা হলে সল্ট লেকে এসে গেলে? আমি মৌনভাবে ব্যাপারটা স্বীকার করলাম।
আরেক ভদ্রলোক, ঠিক ভদ্রলোক নন একদা সাহেব ছিলেন, আমার চেয়ে তিন ধাপ ওপরে চাকরি করতেন যখন তিনি অবসর নেন বছর কুড়ি আগে, মুখের বাঁধানো দাঁতজোড়া জিব দিয়ে ভাল করে সেট করতে করতে বললেন, আরে মিস্টার রায়, আপনি দেখছি ভয়ংকর মোটা হয়ে গেছেন।
এরকম কথা সাতসকালে শুনতে আমার ভাল লাগে না। বলতে পারতাম, ভয়ংকর মোটা হয়েছি তো বেশ করেছি। তাতে কার কী? আপনার খেয়ে-পরে তো মোটা হইনি। তা না বলে অন্যভাবে বললাম, ভয়ংকর মোটা হইনি। কিছুটা মোটা হয়েছি। ভয়ংকর মোটা হলে কি আর এই পনেরো বছর বাদে চিনতে পারতেন?
আমার এই বোকা রসিকতায় ওঁরা সকলেই আমার দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে রইলেন। ঠিক এই সময়ে আমি চিরকাল যে রকম প্রগলভ আচরণ করেছি তাই করে ফেললাম, মুখ ফসকিয়ে বলে ফেললাম, স্যার আপনাদের সঙ্গে আবার দেখা হবে ভাবিনি।
স্যার বললেন, কেন?
আমি বললাম, আমার কেমন একটা ধারণা ছিল আপনার কেউ নেই। এমনকী কেমন যেন মনে হচ্ছে আপনাদের কারও কারও মৃত্যুসংবাদ পেয়ে অফিসে শোকসভা করেছি, ঘণ্টা দুয়েক আগে অফিস ছুটি দিয়েছি।
জারুল গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে নবোদিত সূর্যের রশ্মি রাস্তায় ছড়িয়ে পড়েছে, শিশির-ভেজা ঘাসের ওপর শালিকেরা হুটোপুটি করছে, একটু উত্তুরে হাওয়া দিয়েছে, একটু শীত শীত ভাব। সমবেত ভদ্রমণ্ডলী আমার কথা শুনে বজ্রাহতের মতো দাঁড়িয়ে রইলেন। সব নিস্তব্ধ, শুধু দূরে একটা ঘুঘুর ডাক শোনা যাচ্ছে। একটু পরে নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে, অন্য এক স্যার বললেন, বুড়ো হয়ে তোমার একটুও লাভ হয়নি। তুমি সেই একই রকম ফাজিল রয়ে গেলে।
আমি রণে ভঙ্গ দিলাম। বাড়ি ফেরার পথে ভাবতে লাগলাম, বুড়ো হয়ে সত্যি কী লাভ হল। এবং ওঁরা সবাই সত্যি জীবিত কি না।
ফল হল, আমি প্রাতঃভ্রমণ করা ছেড়ে দিলাম। আরও দু-চারদিন যে চেষ্টা করিনি তা নয়। কিন্তু পরিণতি একই হয়েছে। যারা নেই বলে জানি, তাদের সঙ্গেই ক্রমাগতু দেখা।