এবার একটা ছোট নাটক হল।
কিশোরের বউ শ্যামাসুন্দরীর চরিত্র বিয়ের আগে যেমন ছিল, বিয়ের পরেও তাই রয়েছে। মোটেই বদলায়নি। কিন্তু সে তার চরিত্রদোষের কথা ঘুণাক্ষরেও কিশোরকে টের পেতে দেয় না। তবু অত্যন্ত সেয়ানা হওয়া সত্ত্বেও আজ সে একেবারেই আঁচ করতে পারেনি যে, তার স্বামী যার সোমবার সকালে ফেরার কথা সে শুক্রবার রাত কাবার হওয়ার আগেই ফিরে আসবে।
শোয়ার ঘরে আলো জ্বলছিল, বড় ডাবল বেডের খাটে শ্যামা শুয়েছিল। সহসা ঘরের মধ্যে কিশোর ও জমাদারসাহেবের প্রবেশ। শ্যামা এবং শ্যামার সঙ্গী দুজনেই পরস্পরের কণ্ঠলগ্ন হয়ে ঘুমে অচেতন, কেউ কিছু টের পেল না।
শয়নঘরের ঘনিষ্ঠ দৃশ্য দেখে জমাদারসাহেব বেরিয়ে আসছিলেন, তাকে হাতে ধরে দাঁড় করাল কিশোর, তারপরে বিছানার দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল, ওই যে দেখুন, বালিশের ওপর খোলা চুল, নীল শাড়ি পরা ওই হল শ্যামাসুন্দরী আমার ওয়াইফ, আর ওর পাশে ওর গলা জড়িয়ে শুয়ে ওই হলাম আমি, কিশোরকুমার পাল, এই বলে কিশোর নিজেকে নির্দেশ করল।
অবস্থা কিছু বুঝতে না পেরে কিশোরের হাত ছাড়িয়ে জমাদারসাহেব তোবা তোবা করতে করতে এক দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে রাস্তায় কালো গাড়িতে উঠে বসলেন। হুশ করে ধোঁয়া ছেড়ে ভ্যানটা চলে গেল।
জমাদারসাহেবকে আরও কিছু বোঝানোর জন্যে তার পিছু পিছু কিশোর সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে এসেছিল। কিন্তু জমাদারসাহেব রণে ভঙ্গ দেওয়ায় সে বিফলমনোরথ হয়ে সিঁড়ির নীচের আলো নিবিয়ে সদর দরজা বন্ধ করে দোতলায় উঠে গেল। তারপর গুটিসুটি হয়ে শ্যামাসুন্দরীর পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ল।
সিঁড়িতে পায়ের শব্দ আর ঘরের মধ্যে কথাবার্তা শুনে একটু আগেই শ্যামাসুন্দরীর ঘুম ভেঙেছিল। এমন বিপদে সে আর কখনও পড়েনি। সিঁড়ি দিয়ে কিশোর যখন নেমে গেল সে ভেবেছিল এখনকার মতো কিশোর বিদায় হল, পরে যদি আজকের ব্যাপারে কোনও কথা তোলে, ঝেড়ে অস্বীকার করবে। বলবে, মাতাল অবস্থায় কী না কী দেখেছ, তার ঠিক নেই।
কিন্তু এখন কিশোর এসে পাশে শুয়ে পড়ায় শ্যামাসুন্দরী বিচলিত বোধ করতে লাগল। তবু ভাল যে এপাশে শুয়েছে, ওপাশের লোকটার ওপরে গিয়ে পড়েনি!
কিশোরের মাথার মধ্যে কী সব এলোমেলো চিন্তা ঘুরছিল। একটু আগে সে কী একটা দেখেছে যেটা মোটেই ঠিক নয়। সে শ্যামাকে একটা ধাক্কা দিল, শ্যামা জবাব দিল, উ!
কিশোর শ্যামাকে বলল, ওগো আমাদের বিছানায় তোমার পাশে আর কেউ কি শুয়ে আছে?
এ প্রশ্ন শুনে শ্যামা ধমকিয়ে উঠল, কী-যা তা বলছ! মদ টেনে টেনে তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে!
ধমক খেয়ে একটু চুপসিয়ে গেল কিশোর। কিন্তু তবুও তার মনের মধ্যে সন্দেহের কাটা খোঁচা দিতে লাগল। সে বালিশ থেকে একটু মাথা উঁচু করে নীচে পায়ের দিকে তাকিয়ে ভাল করে গুনল, তারপর জিজ্ঞাসা করল, ওগো, বিছানায় যদি আর কেউ না থাকবে তবে নীচের দিকে ছটা পা দেখা যাচ্ছে কী করে?
এ কথায় চতুরা শ্যামাসুন্দরী কপাল চাপড়িয়ে কেঁদে উঠল, ছিঃ ছিঃ, আমার নামে এই অপবাদ! আমি দুশ্চরিত্রা? আমি মিথ্যাবাদী?
বোকা বনে গিয়ে শ্যামাসুন্দরীর মাথায় হাত বুলাতে বুলোতে কিশোর স্বীকার করল যে সে অনেক মদ খেয়েছে সন্ধ্যা থেকে, প্রায় দেড় বোতল। সুতরাং তার ভুল হতেই পারে। মাতালে তো সব জিনিসই বেশি বেশি দেখে। হয়তো চারটে পা-কেই সে ছটা পা দেখেছে, নেশার ঘোরে গুনতে ভুল করেছে।
শ্যামাসুন্দরী এখন ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদতে লাগল আর বলতে লাগল, তুমি কী করে আমাকে দুশ্চরিত্রা ভাবলে! এসব মদ খেয়ে নেশার ঘোরে অনুমানের কথা নয়, তুমি একবার খাট থেকে নেমে আমাদের পা-গুলো গুনে এসো, তারপরে আমাকে বলল।
কিশোরের তখন মাথা টলছে তবু স্ত্রীর আদেশে খাট থেকে নেমে পায়ের কাছে গিয়ে খুব সতর্ক হয়ে বেশ কয়েকবার পায়ের সংখ্যা গুনল। বলা বাহুল্য, প্রত্যেকবারই পায়ের সংখ্যা দাঁড়াল চার। এক, দুই, তিন, চার–এইভাবে বারকয়েক গুনবার পরে কিশোর বলল, ওগো, আমাকে মাপ করে দাও। সত্যিই নেশার ঘোরে আমি পা গুনতে ভুল করেছিলাম। ঠিক দুজনার চারটে পা-ই রয়েছে। বিছানায়।
তারপর খাটের নীচে বসে অনুতপ্ত কিশোর সামনের পা-দুটো জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। সে পা-দুটো যে কার কে জানে!
অবসরের দিনলিপি
ভালই আছি।
ভেবেছিলাম খুব ছাড়া ছাড়া, নিঃসঙ্গ হয়ে যাব।
এক সঙ্গে দুটো বড় ব্যাপার ঘটে গেল। আমার মত ঘর-গৃহস্থী মানুষের পক্ষে দুটো বড় মাপের জবরদস্ত জীবন বিদারক ঘটনা।
এক নম্বর হল, চাকরি থেকে অবসরগ্রহণ করলাম। পঁয়ত্রিশ বছরের দশটা-পাঁচটা থেকে অব্যাহতি। অবসরগ্রহণ করলাম কথাটা যদিও সঠিক নয়। কথাটা অবশ্য সম্মানজনক, যেন আমি স্বেচ্ছায় অবসরগ্রহণ করেছি। কিন্তু সত্যি কথাটা হল বয়েস হয়ে যাওয়াতে অবসর নিতে বাধ্য হলাম।
দুনম্বর ব্যাপারটা হল আরও গুরুতর। পুরনো বাসস্থান ছেড়ে নতুন বাসায় চলে এলাম। সরকারি আবাস ছাড়তেই হত।
তবে এই শেষ বাসাবদল। খুব সম্ভব এর পরে আর বাসা বদলাতে হবে না। গত পঁয়তাল্লিশ বছরে এই পোড়া শহরে বাক্স-বিছানা ঘাড়ে করে কত জায়গায় যে ছুটলাম। শুরু হয়েছিল সেই সাহেব পাড়ায় নাবালক বয়েসে এসপ্ল্যানেডের গলিতে, তারপর দক্ষিণ দিকে হটতে হটতে বিদায় নিলাম গড়িয়াহাটার কাছ থেকে।