যমুনাদেবীর মুখভাব দেখে সুজাতা নিজে থেকেই বলল, মামাকে ফোন করেছিলাম। মামাই বোধহয়, অ্যাম্বুলেন্সটা নিয়ে এসেছে।
সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে যমুনাদেবী দেখলেন সুজাতার মামা পরেশবাবু সুজাতাদের ফ্ল্যাটে ঢুকে গেলেন, তার পিছে পিছে স্ট্রেচার নিয়ে সাদা পোশাক পরা দুই ব্যক্তির সঙ্গে আরও একজন। তার গলায় স্টেথস্কোপ। এরাও ঢুকল।
এদিকে পরেশবাবু যার জন্যে ওই অ্যাম্বুলেন্স, স্ট্রেচার ইত্যাদি নিয়ে এসেছেন সেই মনোরমাদেবী এখন অঘোরে ঘুমোচ্ছেন। সুজাতাকে নিজের স্ট্রোকের কথাটা জানিয়েই তিনি কাতরোক্তি করতে করতে মৃত্যু আজ অনিবার্য ভেবে চোখ বুজে শেষ মুহূর্তের জন্যে অপেক্ষা করছিলেন। ওই অবস্থাতেই তিনি একটু পরে ঘুমিয়ে পড়েন এবং যথাসময়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে যান।
এখন স্ট্রেচারবাহীরা পরেশবাবুর পিছে পিছে মনোরমা-সোমনাথের শয়নকক্ষে প্রবেশ করে মনোরমাকে বিছানায় গভীর নিদ্রায় শায়িত দেখে তিনি অচৈতন্য আছেন ভেবে স্ট্রেচারে তুলতে গেল।
মনোরমার ঘুম ভেঙে গেল। ততক্ষণে অন্যান্য ফ্ল্যাটবাড়ির লোকেরা যমুনার ডাকে সাড়া দিয়ে ওই ফ্ল্যাটে এসে গেছে। ঘরের মধ্যে গিজগিজ করছে লোক। হঠাৎ সুখনিদ্রা ভেঙে চোখ মেলে মনোরমা এই ভিড় দেখে কেমন হকচকিয়ে গেলেন। তারপর সামনে নিজের সহোদর ভাই পরেশকে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কী হয়েছে? কী হয়েছে রে পরেশ?
পরেশ তখন বলল, তোমার কী হয়েছে সে তুমিই বলতে পারবে।
শুনে মনোরমা চিন্তায় পড়লেন, একটু দূরে মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, এই সুজাতা কী হয়েছে রে?
সুজাতা বলল, এখনকার কথা বলতে পারব না তবে ঘণ্টা দেড়েক আগে তোমার হার্টঅ্যাটাক হয়েছিল।
মনোরমাদেবী এই কথা শুনে বিছানার ওপর উঠে বসলেন। পাশের টেবিলে রাখা একটা প্লাস্টিকের কৌটো খুলে একটা জর্দা পান বের করে মুখে দিয়ে বললেন, হার্টঅ্যাটাটা কেটে গেছে। এখন একটু ক্যানসার ক্যানসার লাগছে। মুখে পানটা চিবোচ্ছি, জিবটা কেমন জ্বালা করছে।
অনতিবিলম্বে স্ট্রেচারসহ স্ট্রেচারবাহীরা সঙ্গে সেই স্টেথস্কোপবাহী ডাক্তার ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে গেলেন। কিন্তু তাঁরা সিঁড়ি দিয়ে নামার আগেই সুজাতা গিয়ে পথ আটকাল, আপনারা যাবেন না, পাশের ঘরে রোগী আছেন, আমার বাবার হার্টঅ্যাটাক হয়েছে।
কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় অ্যাম্বুলেন্সের লোকেরা সিঁড়ির ওপর দাঁড়িয়ে গেল। তবে তারা কিছু বুঝবার আগেই পাশের ঘর মানে সুজাতার ঘর থেকে যমুনাদেবী বেরিয়ে এলেন। তিনি এসে ঘোষণা করলেন, না, সোমনাথবাবুর অ্যাম্বুলেন্স লাগবে না। তিনি ভাল হয়ে গেছেন৷ বুকে ম্যাসেজ করে তার হার্টঅ্যাটাক সারিয়ে দিয়েছি। তিনি এবার ঘুমিয়ে পড়েছেন।
নানা রকমের কানাঘুষা করতে করতে প্রতিবেশীরা একে একে চলে গেল নিজেদের শেষ রাতের ঘুমটুকু পুষিয়ে নিতে। স্ট্রেচারবাহীরা কটু ভাষায় গালমন্দ করতে করতে লাল আলো জ্বালিয়ে তীব্র সাইরেনের ধ্বনি তুলে গেল।
» ২৫০%
আমাদের এই রাজ্যেরই কোনও এক জেলায় পাশাপাশি দুটি অঞ্চলে, দক্ষিণ রামপুর এবং উত্তর রামপুর। নামেই মালুম দক্ষিণ রামপুরের লোকেরা খুবই প্রতিক্রিয়াশীল, ফ্যাসিবাদী, মৌলবাদী ইত্যাদি, ইত্যাদি। উত্তর রামপুরের লোকেরা, স্বভাবতই, প্রগতিশীল, সাম্রাজ্যবাদ এবং সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী।
দক্ষিণ রামপুরের অঞ্চলপ্রধান হলেন, কান্তচন্দ্র রায়। আর উত্তর রামপুরের অঞ্চলপ্রধান হলেন চন্দ্রকান্ত রায়।
কান্তচন্দ্রের আর চন্দ্ৰকান্তের লোকেরা পরস্পর শত্রু। তারা দুটি বিপরীতমুখী লড়াকু দলের সদস্য।
দক্ষিণ রামপুর আর উত্তর রামপুরের মধ্য দিয়ে পুরনো বাদশাহি সড়ক গেছে, এখনকার ন্যাশনাল হাইওয়ে। সেই হাইওয়ে অতিক্রম করে উত্তরের লোক কদাচিৎ দক্ষিণে যায়, দক্ষিণের লোক কদাচিৎ উত্তরে আসে।
একেবারেই যে আসে না, সে কথা বলা যাবে না। এই তো গত মাসে দক্ষিণের লোকেরা উত্তরে এসে লুঠপাট করে বাড়ি-ঘর সব পুড়িয়ে দিয়ে গেল। তার বদলায় উত্তরের লোকেরা গত সপ্তাহে দক্ষিণের হাসপাতাল ও ইস্কুলে আগুন দিয়েছে।
আগেরবার দক্ষিণের লোকেরা উত্তরের চুয়াল্লিশটি ছাগল ভেড়া সমেত পঁচিশটি গোরু-বাছুর লুট করে নিয়ে যায়। এবার উত্তরের লোকেরা ঝুঁকিজাল নিয়ে এসে দক্ষিণের বড় বিলের সমস্ত মাছ ধরে নিয়ে চলে গেল।
দুই অঞ্চলের দুই প্রধান কান্তচন্দ্র এবং চন্দ্রকান্ত কিন্তু পরস্পর বন্ধুভাবাপন্ন। কেউ কারও শত্রুতা করেন না। তাদের দুজনের মধ্যে গালাগালি, মারামারি, লাঠালাঠি, বোমাবাজি নেই। সে যা করে, তাদের লোকেরা করে। তাদের মাথা ফাটে, বাড়ি পোড়ে, তারা জেল খাটে। কখনও সখনও দুয়েকজন যে খুন হয় না তাও নয়।
কিন্তু এসবের ফলে কান্তচন্দ্র এবং চন্দ্ৰকান্তের সৌহার্দ্যের কোনও ঘাটতি হয় না। দুজনার মধ্যে তলায় তলায় গলায় গলায় ভাব। এই তো সেদিন গোরু ছাগল লুট করে নিয়ে যাওয়ার পরের রবিবারে একজন অচেনা লোক এক থলেভর্তি, তা প্রায় কেজি দশেক হবে, পাঁঠার মাংস চন্দ্রকান্তকে দিয়ে গেল, বলে গেল, কান্তবাবু পাঠিয়েছেন।
চন্দ্রবাবুও সামাজিকতায় পিছিয়ে রইলেন না। দক্ষিণের বিলের মাছ লুট করে নিয়ে আসার দিন সন্ধ্যাতেই এক বালতিভর্তি বড় মাছের টুকরো কান্তবাবুকে পাঠিয়ে দিলেন।