অদূরেই অন্য একটা খাটে মনোরমা শুয়ে আছেন। সোমনাথবাবুর এই অবস্থায় যা কিছু করণীয় সবই মনোরমাকেই করতে হবে। কিন্তু সোমনাথ মনোরমাকে ডাকার সাহস পাচ্ছেন না।
গতকাল সকাল থেকে মনোরমাদেবীর জিভে ক্যানসার হয়েছে। এখনও ডাক্তার দেখানো হয়নি তবে মনোরমাদেবী নিশ্চিত যে তার ক্যানসারই হয়েছে। সোমনাথ একবার বলার চেষ্টা করেছিলেন যে মনোরমার মাড়ির যে দাঁতটা কিছুদিন আগে ভেঙে গেছে, সেই ভাঙা দাঁতের ঘষাতেই জিভটা ছড়ে ছড়ে কেটে গিয়েছে। সোমনাথ বোঝাতে চেয়েছিলেন যে ভাঙা দাঁতটা তুলে ফেললে এবং জিভে একটা লোশন লাগালেই এ যাত্রা কর্কট রোগের হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে, কিন্তু কে শোনে কার কথা।
এ তবুও ভাল বলা যায়। গতবছর পুজোর সময় মনোরমার যখন ব্রেনে ক্যানসার হয়েছিল তখন সোমনাথ নিজেও ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। রীতিমতো পয়সা খরচ হয়েছিল, ব্রেন স্ক্যান থেকে অনেক কিছু করতে হয়েছিল, তবে এরই মধ্যে এইডসে আক্রান্ত হয়ে যাওয়ায় মনোরমাদেবীর ব্রেন ক্যানসারটা চাপা পড়ে যায়।
আজ রাতে কিন্তু সোমনাথবাবু ভরসা পাচ্ছেন না মনোরমাকে তার গুরুতর শারীরিক অবস্থার কথা জানাতে। মনোরমাদেবী পাশের খাটে চোখ বুজে ঘুমিয়ে আছেন, আহা ক্যানসারের রোগী, তার আর কতটুকুই বা ক্ষমতা।
কিন্তু এদিকে যে সোমনাথবাবুর বুকের ব্যথা আবার অসহ্য হয়ে উঠেছে। অবশেষে আজ রাতে বিনা চিকিৎসায় প্রাণ যেতে বসেছে তাঁর।
এখন একমাত্র সুজাতা ভরসা। সে যদি ডাক্তারবাবুকে ফোন করে, পাড়া-প্রতিবেশীকে খবর দেয় হয়তো সুচিকিৎসা হলে প্রাণটা বাঁচলেও বাঁচতে পারে।
কোনও রকমে বিছানা আঁকড়িয়ে ধরে মেঝেতে নামলেন সোমনাথবাবু। পাশের ঘরেই সুজাতা থাকে। দেওয়াল ধরে ধরে সুজাতার ঘরের কাছে পৌঁছালেন তিনি।
সুজাতার ঘরে আলো জ্বলছে। বোধহয় পরীক্ষা সামনে তাই রাত জেগে পড়াশুনা করছে মেয়েটা। দরজাটা আলগা করে ভেজানো। দরজার কাছে গিয়ে সোমনাথবাবু শুনতে পেলেন ঘরের মধ্যে কী যেন সব কথাবার্তার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। সর্বনাশ, এত রাতে আবার মেয়েটার ঘরে কে?
দরজায় ঠুকঠুক করে আওয়াজ করলেন। সুজাতা বিছানা থেকে তড়াক করে লাফিয়ে এসে দরজা খুলল। ঘরের মধ্যে অন্য লোকজন কেউ নেই। তবে একটা টিভি চলছে। টিভিতে চ্যানেল ভি নাকি চ্যানেল পাঁচ কী একটা চলছে, জামাকাপড় প্রায় খুলে ফেলে ধুন্ধুমার নাচ, গান, বিলিতি বাজনা শব্দটা খুব কমিয়ে দিয়ে সুজাতা তাই দেখছিল।
বাবাকে দেখে চিন্তান্বিত হয়ে সুজাতা জিজ্ঞাসা করল, তোমার আবার কী হল?
কোনও রকম কথা বলতে পারলেন না সোমনাথ। বুকে হাত দিয়ে মেয়ের পড়ার টেবিলটায় ভর দিয়ে সামনের চেয়ারটায় বসে পড়লেন সোমনাথবাবু।
বিচক্ষণা মেয়ে, অবস্থা বুঝতে তার বিশেষ অসুবিধে হল না। অসুবিধে হওয়ার কথাও নয়, সুজাতার এ বিষয়ে যথেষ্ট পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে।
সুজাতা গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞাসা করল, হার্টঅ্যাটাক?
সোমনাথবাবু মৃদু স্বরে বললেন, হ্যাঁ।
এবার সুজাতাকে বেশ চিন্তিত দেখাল, সে বলল, কিন্তু মারও তো হার্টঅ্যাটাক হয়েছে।
খবরটা শুনে এই রকম শারীরিক অবস্থার মধ্যেও সোমনাথ খুব বিব্রত বোধ করলেন। একটু কষ্ট করে দম নিয়ে ধরে ধরে বললেন, সে কী? কখন?
সুজাতা এগিয়ে গিয়ে টিভিটা বন্ধ করে দিয়ে এসে বলল, রাত একটা নাগাদ হবে। তারপর সোমনাথকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। আমি ছোট মামাকে ফোন করে দিয়েছি।
সুজাতার ছোট মামা মানে সোমনাথের ছোট শ্যালক পরেশ কাছেই থাকেন মাইল দেড়েকের মধ্যে। তা ছাড়া পরেশবাবুর একটা সুবিধে এই যে তার নিজের একটি গাড়ি আছে এবং হাসপাতাল-নার্সিংহোমে ভরতি করানোয় তিনি একজন এক্সপার্ট। সুদক্ষ ব্যক্তি ছাড়া চিকিৎসালয়ে ভরতি করানো আজকাল যার তার পক্ষে সম্ভব নয়।
পরেশবাবু তাঁর দিদি-জামাইবাবুর ব্যাপারটা সম্যক জানেন। কখন কী অবস্থা নেওয়া উচিত সে বিষয়ে পরেশবাবুর বাস্তববোধ আছে।
ভাগিনেয়ীর ফোন পেয়ে পরেশবাবু খুব যে একটা চিন্তিত বোধ করেছেন তা নয়। কিন্তু এরকম সংবাদ পেয়ে চুপ করে বসে থাকাও যায় না। হঠাৎ যদি কিছু হয়ে যায়।
পরেশবাবু এসে গেলেন। একটা ঝকঝকে অ্যাম্বুলেন্স গাড়ির মাথায় লাল আলো ঘুরপাক খাচ্ছে, তার সামনে পথ দেখিয়ে পরেশবাবুর গাড়ি। জামাইবাবুদের ফ্ল্যাটবাড়ির উঠোনটায় নিজের গাড়ি ও অ্যাম্বুলেন্স রেখে পরেশবাবু দোতলায় উঠে এসেছেন।
ইতিমধ্যে সুজাতা গিয়ে তিনতলায় যমুনাদেবীকে বাবার খবর দিয়েছে। যমুনাদেবী বুদ্ধিমতী মহিলা, তিনি আশেপাশের ফ্ল্যাটে জানা-চেনা, মিশুক স্বভাবের যারা আছেন যেটুকু সময় পেয়েছেন তার মধ্যে তাদের ফোন করে সোমনাথের অবস্থা জানিয়েছেন।
সুজাতা কিন্তু যমুনাদেবীকে তার মা মনোরমাদেবীর হার্টঅ্যাটাকের কথা বুদ্ধি করেই কিছু বলেনি। এক সঙ্গে স্বামী-স্ত্রী দুজনের হার্টঅ্যাটাকের সংবাদ পেয়ে তার কী প্রতিক্রিয়া হবে এই ভেবে সুজাতা খবরটা চেপে যায়।
সুজাতাকে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামার মুখে সিঁড়ির জানলা দিয়ে যমুনাদেবী দেখলেন, উঠোনে অ্যাম্বুলেন্স দাঁড়িয়ে। অ্যাম্বুলেন্স এসে যাওয়ায় যমুনাদেবী একটু আশ্বস্ত হলেন, যাক তা হলে পুরো ঝামেলাটা তার কাঁধে পড়বে না।