বমি হলে তবু ভাল লাগত। কিন্তু খুব চেষ্টা করেও, গলায় আঙুল দিয়েও বমি করতে পারলেন না। সোমনাথ। এদিকে বুকের ব্যথাটা কমছে, বাড়ছে। হার্টঅ্যাটাক হয়েছে সুনিশ্চিত ধরে নিয়ে ফুল স্পিড পাখার তলায় বিছানার ওপরে বালিশে ঠেস দিয়ে বসে দরদর করে ঘামতে লাগলেন সোমনাথ।
অবশ্য এই প্রথম নয়, সোমনাথের মাঝে মধ্যেই হার্টঅ্যাটাক হয়ে থাকে। এই তো গত বুধবারেই সোমনাথবাবুর একবার হার্টঅ্যাটাক হয়ে গেছে। সকালে বাজার করে বাড়ি ফিরছিলেন। বাড়ির দরজার সামনে তার হার্টঅ্যাটাক হল। কোনও রকমে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় নিজের ফ্ল্যাটের সামনে উঠে বাজারের থলেটা সিঁড়ির মুখে ফেলে দিলেন, কলিংবেলটা আর টেপার ক্ষমতা নেই। মেঝেতে হাটুমুড়ে বসে বাঁ হাতে দরজার কড়াটা নাড়বার ক্ষীণ চেষ্টা করতে লাগলেন ডান হাতে বুকটা চেপে ধরে।
এই সময় তিনতলার মিস যমুনা চক্রবর্তী সিঁড়ি দিয়ে নামছিলেন, তিনি সোমনাথবাবুকে এই ভয়াবহ অবস্থায় দেখে দাঁড়িয়ে গেলেন, যমুনাদেবীর অফিস যাওয়ার তাড়া ছিল, কিন্তু প্রতিবেশীসুলভ কর্তব্যবোধে তিনি সোমনাথবাবুর মাথার ওপর দিয়ে হাত বাড়িয়ে কলিংবেলটা টিপে দিলেন।
এ বাড়িতে সহজে দরজা খোলে না, কলিংবেল অনেকক্ষণ ধরে টিপতে হয়। বাড়িতে সদস্য সংখ্যা মাত্র তিনজন। সোমনাথবাবু, তার স্ত্রী মনোরমাদেবী এবং একমাত্র কন্যা সুজাতা। এ ছাড়া একটি ঠিকে কাজের মেয়ে আছে। আগে তার নাম ছিল পাঁচুর মা, এখন তার নাম শতাব্দী।
সুজাতা সকাল সাড়ে পাঁচটায় বেরিয়ে গেছে মর্নিং কলেজ করতে। শতাব্দী অবশ্য সাড়ে আটটা পর্যন্ত ছিল, বাসন মেজে, ঘর ঝাড় দিয়ে, মুছে সেও সময়মতো চলে গেছে।
এখন বাড়ির মধ্যে সোমনাথগৃহিণী শ্রীযুক্তা মনোরমা একা।
কিন্তু মনোরমাদেবীর খালি বাড়িতে একা থাকা উচিত নয়। তিনি হার্টের রোগী। তা ছাড়া মাঝে মধ্যে তাঁর ক্যানসার হয়। একবার এইডস হয়েছিল।
অবশ্য, এইডস হওয়া ব্যাপারটা বেশিদূর গড়ায়নি। কারণ সোমনাথবাবু তার স্ত্রীকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে এইডস হওয়া ভাল নয়। ব্যাপারটা তাদের দুজনের পক্ষেই খুব অসম্মানজনক, তা ছাড়া পাড়ার লোকে ঘুণাক্ষরেও টের পেলে পাড়ায় বসবাস করা সম্ভব হবেনা। গায়ের জোরে থেকে গেলেও একঘরে হয়ে থাকতে হবে, শুধু ধোপা-নাপিত নয়, কাজের মেয়ে থেকে অকাজের প্রতিবেশিনী এমনকী খবরের কাগজওলা, ডাকপিয়ন, ইলেকট্রিক মিস্ত্রি বাড়িমুখো হবে না।
সোমনাথবাবু অবশ্য আরও একটু বাড়িয়ে বলছিলেন, তবে খুন-ডাকাতি-রাহাজানি করতে পারলে সুবিধে আছে, থানা থেকে একটি সেপাইও ধরতে আসবে না, ফৌজদারি আদালতের কোনও পেয়াদা। সমন ধরাতে আসবে না।
এত কথা মনোযোগ দিয়ে শোনার মহিলা মনোরমাদেবী নন। তিনি শুধু একটি সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন করেছিলেন, তা আমার এইডস হলে তোমার অসম্মান হবে কেন? আমরা জানি না মনোরমাদেবীকে ব্যাপারটা কী ভাবে বুঝিয়েছিলেন সোমনাথবাবু, উত্তরযৌবন দাম্পত্য জীবনের সেই নিগূঢ় সমীক্ষায় আমার কোনও কৌতূহল নেই।
মনোরমা অবশ্য আরও জানতে চেয়েছিলেন, আমার যদি এইডস না হয়ে থাকে তবে আমার সর্দি সারে না কেন?
মোক্ষম প্রশ্ন। এইডসের সারমর্ম কী করে যে মনোরমাদেবী জেনেছিলেন। সোমনাথবাবুও ব্যাপারটা জানেন, এইডস কোনও রোগ নয়, রোগের বন্ধু। এইডস আক্রান্ত ব্যক্তির কোনও অসুখ হলে সেটা সারে না, সারবে না।
বলা বাহুল্য, এই রচনা এইডস বিষয়ক কোনও কথোপকথননির্ভর শিক্ষামূলক মামুলি প্রবন্ধ নয়।
সুতরাং আমাদের ফিরে যেতে হবে সেই বুধবার সকালে যখন সিঁড়ির ওপরে নিজের ফ্ল্যাটের দরজার সামনে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে সোমনাথবাবু বুকে হাত দিয়ে বসে পড়েছিলেন।
তিনতলার ফ্ল্যাটের যমুনাদেবী কলিংবেল বাজিয়ে যখন অনেকক্ষণ পরে পায়ের শব্দ পেলেন, মৃদু হেসে সোমনাথবাবুকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আপনার আবার হার্টঅ্যাটাক হল?
এই শোচনীয় মুহূর্তে ভদ্রমহিলার এরকম পরিহাস, কিন্তু যমুনাদেবীকে দোষ দেওয়া যায় না। তিনি রীতিমতো ভুক্তভোগিনী।
গত ছয় মাসে অন্তত তিন চারবার মধ্য বা শেষরাতে, বাংলা বনধের দুপুরে যমুনাদেবীকে অন্যান্য প্রতিবেশীর সঙ্গে ছুটোছুটি করতে হয়েছে হৃদরোগাক্রান্ত সোমনাথবাবুকে হাসপাতাল বা নার্সিংহোমে পৌঁছে দেওয়ার জন্য।
গত বুধবারে অবশ্য যমুনা চক্রবর্তী বেশ সহজেই অব্যাহতি পেয়েছিলেন কিংবা বলা যায় অফিসের তাড়াতাড়ির জন্য পালিয়ে বেঁচেছিলেন। মনোরমা দরজা খোলা মাত্র তার হাতে স্বামীকে গছিয়ে দ্রুত পায়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গিয়েছিলেন যমুনা।
বিকেলে অফিস থেকে ফিরে যমুনা সোমনাথের খোঁজ করেছিলেন, অফিসে নানা কাজের মধ্যে সারাদিনই মনটা খুঁতখুঁত করেছিল, কী জানি ভদ্রলোকের যদি সত্যিই হার্টঅ্যাটাক হয়ে থাকে।
বিকেলে খোঁজ নিয়ে দেখলেন তার আশঙ্কা অমূলক। পাড়ার মোড়ে ছেলেরা ম্যারাপ বেঁধে রবীন্দ্র-নজরুল সন্ধ্যা করছে। সেখান সোমনাথবাবু গেছেন আবৃত্তির বিচারক হয়ে।
আজ রাত দুটোয় বিছানার ওপর বুকে হাত দিয়ে বসে ঘামতে ঘামতে গত বুধবারের অবস্থাটা মনে করছিলেন সোমনাথ। কিন্তু আজকেরটা সেদিনের মতো মিথ্যে অ্যাটাক নয়। বুকের ব্যথা, ঘাম, দমবন্ধভাব–কিছুদিন আগে একটা মেটিরিয়া মেডিকা কিনেছিলেন, সেই বইয়ের হার্টঅ্যাটাকের বর্ণনার সঙ্গে নির্ঘাত মিলে যাচ্ছে। মেটিরিয়া মেডিকাটি সহজ বাংলায় একটি অসুখ ও ওষুধ নির্ণয়ের বই, কয়েকমাস আগে সেটা কেনার পর থেকে সোমনাথবাবু আগাগোড়া পড়ে পড়ে গুলে খেয়েছেন।