আবার সমীরণের নিরাশ হওয়ার পালা। তবু সে দায়ের খাতিরে জিজ্ঞাসা করল, কোও কি কেউ খায় না আজকাল?
শ্রীধর বললেন, খাবে না। আমাদের হরিই হুক্কা ছাড়া কিছু খায় না।
উত্তেজিত সমীরণ জিজ্ঞাসা করল, হরি? হরি কে? কোথায় থাকে?
শ্রীধর বললেন, হরি আমার পুরনো বন্ধু, ওল্ড চাম, মানিকগঞ্জ থেকে দুজনে একসঙ্গে এই শহরে আসি। এই তো কাছেই বউবাজারে থাকে।
সমীরণ বলল, আচ্ছা শ্রীধরদা একদিন আপনার ওই বন্ধুর ওখানে গিয়ে হুঁকো খাওয়া দেখতে পারি।
শ্রীধর বললেন, হুঁকো খাওয়া আবার দেখার কী আছে? তবে যেতে চাও চল। কবে যাবে?
মিড়নের কথা স্মরণ করে সমীরণ বলল, আমার সঙ্গে কিন্তু একজন থাকবে।
শ্রীধর বললেন, তাতেও আপত্তির কিছু নেই। এসব ক্ষেত্রে লোকে দল বেঁধেই আসে৷
শ্রীধরের কথায় একটু হেঁয়ালি লাগলেও তখনই অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাকা করে ফেলল সমীরণ। সামনের শনিবার সেকেন্ড স্যাটারডে, অফিস ছুটি। সন্ধ্যা ছয়টার সময়ে বউবাজারের মোড়ে বহুদিনই বন্ধ হয়ে থাকা সিনেমাহলের গেটের সামনে সমীরণের জন্য শ্রীধরবাবু প্রতীক্ষা করবেন।
রাস্তায় রাস্তায় সাংঘাতিক যানজট। তবু একটা মিনিবাসে করে ছয়টা বাজার কয়েক মিনিটের মধ্যে মিড়নকে নিয়ে সমীরণ এসে দেখল শ্রীধরবাবু পঁড়িয়ে আছেন।
শ্রীধরবাবু সমীরণের সঙ্গে মিড়নকে দেখে একটু যেন বিব্রত হলেন। তিনি বোধহয় ভেবেছিলেন সমীরণের সমবয়সি কোনও বন্ধু আসবে।
সমীরণ মিড়নকে দেখিয়ে শ্রীধরবাবুকে বলল, আমার ছেলে।
শ্রীধর বললেন, বাবাজীবনকে সঙ্গে এনেছ তা কী আর করা যাবে, চলো।
কোথায় যাচ্ছে তারা? শ্রীধরবাবুর বাক্যভঙ্গি কেমন গোলমেলে মনে হল সমীরণের। তা হোক, এসে যখন গেছে হুঁকোটা মিড়নকে দেখিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
মিড়নও বাবার হাত ধরে শ্রীধরবাবুর সঙ্গে সামনের একটা গলির মধ্যে ঢুকতে ঢুকতে সমীরণকে জিজ্ঞাসা করল, বাবা, সত্যি সত্যি হুঁকো দেখতে পাওয়া যাবে?
সমীরণের আগেই শ্রীধর জবাব দিলেন, হ্যাঁ, নিশ্চয় দেখতে পাবে। আর একটু এসো।
কিন্তু গলির মধ্যে ঢুকে সমীরণের কেমন খটকা লাগল। এটা কেমনতর জায়গা। দরজায় দরজায়, সিঁড়িতে রাস্তায় মেয়েরা মুখে রং মেখে হল্লা করছে, সিগারেট ফুকছে। এটা তো খারাপ পাড়া মনে হচ্ছে! এ কোথায় এল সে ছেলেকে নিয়ে! রাস্তায় দাঁড়ানো রমণীদের মধ্যেও কেউ কেউ মিড়নকে দেখে অবাক হচ্ছে, এইটুকু ছেলেকে নিয়ে কেউ তো এসব জায়গায় আসে না।
বাধ্য হয়ে থমকে গিয়ে সমীরণ শ্রীধরকে বলল, শ্রীধরদা এ কোথায় যাচ্ছি আমরা?
অমিত শ্রীধর বললেন, অস্বস্তি হলে চোখ বুজে চলে এসো। ওই তো মোড়ের বাড়ির দোতলায় হরিমতী থাকে।
অবাক হয়ে সমীরণ বলল, হরিমতী?
শ্রীধর বললেন, কাল হরির কথা বলছি না, সেই হরি, হরিমতী, আমার ওল্ড চাম। হরিই তো হুক্কা খায়। তারপর একটু থেমে সামনের দোতলায় জানলার দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললেন, ওই দ্যাখো দোতলার জানলা দিয়ে তামাকের ধোঁয়া বেরোচ্ছে। তামাক তো আজকাল সব জায়গায় পাওয়া যায় না, এই তামাক আমিই সপ্তাহে একদিন বরানগর বাজার থেকে এনে ওকে দিই।
দোতলার জানলায় সত্যিই ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে। তামাকের গন্ধও একটু নাকে আসছে। সেই ধূমায়িত জানলার দিকে লক্ষ্য রেখে দরজায় দাঁড়ানো বিস্মিত কুলটাকুলের পাশ কাটিয়ে শ্রীধরের পিছু পিছু নয় বছরের ছেলের হাত ধরে জীবনে এই প্রথমবার নিষিদ্ধপল্লির কোনও গৃহে প্রবেশ করল সমীরণ।
হৃদয় ঘটিত
রাত দুটো নাগাদ সোমনাথ স্পষ্ট বুঝতে পারলেন যে তার হার্টঅ্যাটাক হয়েছে। সাড়ে দশটায় ভাত খেয়ে এগারোটার সময় শুয়েছিলেন। তখন থেকেই মনটা কেমন যেন খুঁতখুঁত করছিল, শরীরেও অস্বস্তি বোধ হচ্ছিল। দুটো ঘুমের বড়ি খেয়ে তবুও ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। মিনিট পনেরো হল সোমনাথবাবুর ঘুম ভেঙে গেছে।
ঘটনার শুরু অবশ্য সন্ধ্যাবেলায়। রিটায়ার্ড মানুষ সোমনাথবাবু প্রতিদিন বাড়ির পাশের পার্কটায় গিয়ে পায়চারি করেন, সকালের দিকে একবার, আর সন্ধ্যার দিকে একবার।
আজও সন্ধ্যায় তাই করেছেন। তবে তার সঙ্গে একটু অতিরিক্ত করেছেন। পার্কের বেঞ্চিতে বসে অল্প চিনেবাদাম কিনে খেয়েছেন। অল্প মানে এক টাকার চিনেবাদাম, ছোট একটা ঠোঙা, গোনাগুনতি ছোটবড় পনেরো-বিশটার বেশি বাদাম হবে না। সোমনাথবাবুদের অল্প বয়েসে, সেই পুরনো কালের এক আনায় এর দ্বিগুণ পরিমাণ বাদাম পাওয়া যেত।
তবে ডাক্তারিসম্মতভাবেই বাদামগুলো খেয়েছিলেন সোমনাথবাবু। একালের ডাক্তারেরা বলেন, বেশি আঁশযুক্ত মানে ফাঁইবারওলা খাবার খেতে, সেই নির্দেশ মান্য করে সোমনাথবাবু বাদামগুলো খোসাসুদ্ধ চিবিয়ে খেয়েছিলেন। খেতে খুব ভাল লেগেছিল তা নয়, কিন্তু স্বাস্থ্যের কারণে খেয়েছিলেন।
হয়তো বাদাম না কিনলেও চলত, সেটাই ভাল হত। এই বয়েসে বাদাম খাওয়ার খুব লোভও নেই সোমনাথবাবুর। কিন্তু আজ বিকেলে এক যুবতী বাদামওয়ালিকে দেখে তিনি অভিভূত হয়ে যান। যদিও বিকেলবেলা জল খাওয়ার পরে আর রাতের খাবারের আগে এর মধ্যে সোমনাথবাবু কিছুই খান না, এই বয়েসে বাদামওয়ালির লাস্য দেখে এবং মধুর অনুরোধ শুনে তিনি ভুল করেছিলেন।
বুকের ব্যথাটা ক্রমশ ঠেলে ঠেলে উঠছে। একটা চাপা ঢেকুর, সঙ্গে গলাজ্বালা। সারা শরীরে কেমন। অস্বস্তি হচ্ছে। কয়েকবার বিছানায় উঠে বসলেন সোমনাথবাবু। দুবার বাথরুমে গেলেন। কেমন একটা বমি বমি ভাব।