একথা ওকথার পর গড়গড়ার প্রসঙ্গ উত্থাপন করতে সোনাকাকা বললে, গড়গড়ার কথা আর বোলো না। সেটা নিয়ে অমু যা বিপদে পড়েছিল। অমু মানে অমরজ্যোতি, সোনাকাকার ছেলে।
জানা গেল, অমু সেই গড়গড়াটা আগেরবার আমেরিকা নিয়ে যাচ্ছিল, সে দেশে এসব ধরনের জিনিসের খুব কদর।
কিন্তু যাওয়ার পথে ওই গড়গড়া নিয়ে দুবার বিপদে পড়ে। প্রথমত নয়াদিল্লি বিমানবন্দরে শুল্ক অফিসারেরা গড়গড়াটাকে মোগল শিল্পের প্রাচীন নমুনা বলে আটকিয়ে দেয়। বহু ধরাধরি করে এবং সেই সঙ্গে গোপনে এক শিশি কিঞ্চিৎ ব্যবহৃত বিলিতি অডিকলন উপহার দিয়ে সেটা উদ্ধার করে।
কিন্তু লস এঞ্জেলসে সেটা সম্ভব হয়নি। সেখানে দুই কৃষ্ণাঙ্গ এবং শ্বেতাঙ্গিনী অফিসারের সেটা নজরে পড়ে। তারা সেটাকে ছাড়েনি। মারাত্মক কিছু ভেবে তারা অমরজ্যোতিকে রসিদ দিয়ে গড়গড়াটাকে নাসায় পরমাণু গবেষণা কেন্দ্রে পরীক্ষা করতে পাঠিয়েছে, আর ফেরত পাওয়া যায়নি।
নিরাশ হয়ে সমীরণ উঠছিল, তখন সোনাকাকা দেরাজ খুলে একটু হাতড়িয়ে ঠাকুরদার সোনার পার্কার কলমটা বার করে সমীরণকে দিয়ে বললেন, কলমটা হারিয়ে গিয়েছিল, হঠাৎ সেদিনই খুঁজে পেয়েছি। এটা তুই রাখ। বাবার জিনিস যত্ন করে রাখিস। আর মাঝেমধ্যে আসিস, বুড়ো কাকা একা থাকি। একটু খোঁজখবর তো নিতে হয়!
এরপর প্রায় আর কিছুই করার ছিল না। তবু উদ্যোগী সমীরণ দুটো কাজ করল।
সে শুনেছিল পুরনো বাংলা সিনেমায় অনেক হুঁকো খাওয়ার দৃশ্য আছে। নন্দনে সপ্তাহব্যাপী প্রাচীন বাংলা ছায়াছবির উৎসব দেখল। তিন শো-তে একুশটা টিকিট কেটে স্ত্রী-পুত্রকে কিছু বুঝতে না দিয়ে পরপর সাতদিন পুরনো ছবি দেখে সপরিবারে বিধ্বস্ত হয়ে পড়ল সমীরণ। কিন্তু কোনও ছবিতে একটাও হুঁকো সেবনের দৃশ্য দেখা গেল না।
এরপরে যাত্রা। কে যেন বলল, যাত্রায় নাকি পৌরাণিক কাহিনিতে বিশ্বামিত্র, নারদ ইত্যাদি মুনিঋষিরা ঘটনার পুরাণত্ব বোঝানোর জন্যে হুঁকো হাতে স্টেজে আসেন।
পৌরাণিক যাত্রা এ বছর খুব কম হচ্ছে। তবু সমীরণ অনেক খোঁজখবর নিয়ে মেমারিতে এক বন্ধুর বাড়িতে থেকে পাশের গ্রামের মণ্ডপে জায়া নই, কন্যা নই, মাতা নই, আমি দ্রৌপদী, এই রকম রোমাঞ্চকর নামের পৌরাণিক পালা দেখে এল। কিন্তু সেখানেও হুঁকোর দেখা মিলল না।
শেষ. শ্রীধর চৌধুরী
অবশেষে উদ্ধার করলেন শ্রীধর চৌধুরী।
শ্রীধর চৌধুরী অতিশয় পাকা লোক। তেল চুকচুকে পাকানো বাঁশের মতো চেহারা, কলপ দেওয়া কালো চুল। পায়ে নাগরা জুতো। এখনও সময় সময় গলায় উড়ুনি জড়ান।
শ্রীধর চৌধুরীর বয়েস কত কেউ জানে না। অফিসও না। সাতচল্লিশ সালে পার্টিশানের পর অপশন দিয়ে সমীরণদের অফিসে আসেন ঢাকা জেলার মানিকগঞ্জ থেকে। সেও চার দশক হয়ে গেল। হিসেবমতো অনেক আগেই রিটায়ার করা উচিত ছিল। তার সার্ভিসবুক হারিয়ে গেছে, নাকি সেই পাকিস্তান থেকে আসেইনি। কিছু প্রশ্ন করলে শ্রীধরবাবু বলেন, রিটায়ার করতে এখন পাঁচ বছর বাকি আছে। এই দ্যাখো মানিকগঞ্জের তারক পণ্ডিতের নিজের হাতে করা ঠিকুজি।
কেউ যদি বলে, কিন্তু এ হিসেবে আপনি যখন চাকরিতে ঢোকেন তখন আপনার বয়েস ছিল বড় জোর পাঁচ কি ছয়। সেটা কী ব্যাপার?
গম্ভীর হয়ে শ্রীধর চৌধুরী বলেন, তখনকার মানিকগঞ্জে ওরকম হত।
সেসব যা হোক শ্রীধরবাবু ত্রিকালজ্ঞ মানুষ। অনেক কিছু জানেন, বোঝেন, খবর রাখেন। নানা রকমের ভাল ভাল দোষ আছে। এটা সেটা পান-ভোজন, এই বয়েসেও এদিকে ওদিকে যাতায়াত, এই সব আর কী!
সমীরণ হুঁকোর প্রসঙ্গ অনায়াসেই সর্বপ্রথমে শ্রীধরবাবুর কাছে তুলতে পারত কিন্তু এটা তার খেয়াল হয়নি।
একই অফিসে পাশের সেকশনে কাজ করেন শ্রীধর চৌধুরী। বয়েসের তফাত থাকলেও শ্রীধরের সঙ্গে অফিসের প্রায় সকলেরই বন্ধুত্বের সম্পর্ক। কাজ-টাজ বিশেষ কিছু করেন না, প্রায় সারাদিনই আড্ডা দিয়ে, গালগল্প করে কাটিয়ে দেন। সেদিন টিফিনের সময়ে ক্যান্টিনে বসে চা খাচ্ছিল সমীরণ। পাশের টেবিলে শ্রীধরবাবু জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছিলেন। সব সময় রসের গল্প তাঁর মুখে।
হঠাৎ বিচ্ছিন্নভাবে তামাক শব্দটা কানে আসতে সমীরণ একটু সতর্কভাবে শোনার চেষ্টা করল শ্রীধরবাবু কী বলছেন; ধোঁয়া, নেশা এসব শব্দও কানে গেল।..
ক্যান্টিনের জটলা ভাঙতে শ্রীধরবাবুকে একটু আলাদা করে সমীরণ জিজ্ঞাসা করলে, শ্রীধরদা টিফিনের সময় তামাক, ধোঁয়া এসবের কথা কী বলছিলেন। হুঁকোর ব্যাপার নাকি?
শ্রীধর বললেন। হুঁকো? হুঁকো শুনলে কেমন হাসি পায়। আমরা দেশে বলতাম হুক্কা, এটাই আসল আরবি শব্দ।
তারপর একটু থেমে বললেন, সাধারণ হুক্কা নয়। আমি বলছিলাম পঞ্চমুখী হুক্কার কথা, ওই যাকে বলে পাঁচরং। পাঁচ মুখে পাঁচটা কলকে, এক সঙ্গে তামাক, গাঁজা, ভাং, হাসিস, চরস। এক টানেই মাথা সাফ।
এতদিন হাজার চেষ্টা করেও একটা একমুখো হুঁকোর দেখা পায়নি সমীরণ আর এখন শুনছে পাঁচমুখো হুঁকোর কথা।
কোথায় দেখতে পাওয়া যাবে এই দুর্লভ বস্তুটিকে? শ্রীধরবাবুর কাছে সমীরণ জানতে চাইল।
শ্রীধর বললেন, এখন আর ও জিনিস কোথায় পাওয়া যাবে? ওসব সাবেকি দিনের জিনিস, সে কি আজকের কথা। পঞ্চরঙ খেতেন মাইকেল, বঙ্কিম, শরৎ চাটুজ্যে। কতকাল হয়ে গেল।