এর উত্তরে দোকানদার বলল, জানেন আমাদের নিমতলা ঘাটের নাম সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে গেছে। সারা পৃথিবী থেকে সাহেব-মেম, নিগ্রো-জাপানি সবাই গাঁজা খেতে আসে মাঝরাত্তিরের নিমতলায়। তারা বড়লোকের জাত এক কলকে দুবার ব্যবহার করে না। এক রাতে একশোটা কলকে বিক্রি হলে পঞ্চাশ টাকা লাভ থাকে। তার ওপরে আছে বখশিশ, গাঁজার লাভের বখরা।
আর কিছু জানার ছিল না সমীরণের। শ্মশানঘাট থেকে সে আশাহত হয়ে বাড়ি ফিরে এল।
কিন্তু এই সূত্রেই সমীরণের মাথায় অন্য একটা বুদ্ধি এল। জগুবাবুর বাজারে তো তামাকের দোকান আছে; সহজে নজরে আসে না কিন্তু মাংসপট্টির ঠিক পিছনে একটা ছোট দোকান বেশ কিছুকাল আগেও সমীরণ দেখেছে। এখনও হয়তো আছে। সেখানে হুঁকোর খোঁজ পাওয়া যাবে। না পাওয়া গেলে সোজা কাজ হবে দোকানের সামনে প্রতীক্ষা করা, যেই কেউ তামাক কিনতে আসবে, কিনে ফিরে যাওয়ার সময় তাকে অনুসরণ করলেই হুঁকোর কাছে পৌঁছে যাবে।
তবু চিন্তা হল সমীরণের। যদি সেই তামাকের দোকান উঠে গিয়ে থাকে।
পরের রবিবার সকালে দুরুদুরু হৃদয়ে জগুবাবুর বাজারের শেষ সারিতে মাংসের পট্টিতে গিয়ে পাঁচশো পাঁঠার মাংস কিনল সমীরণ। পাঁঠার মাংস কদাচিৎ খায় সমীরণ, বয়েস চল্লিশের দিকে এগোচ্ছে। সঙ্গে রক্তচাপ বাড়ছে, রক্তে শ্যাওলা বাড়ছে, মেদ বাড়ছে। ডাক্তার বলেছে লাল মাংস খাবেন না, শুয়োর বা গোরু নয়, নিতান্ত পাঁঠা-খাসির মাংস খায় সমীরণ কিন্তু ডাক্তারের বক্তব্য হল সেটাও লালমাংস, শরীরে মেদ ও রক্তে শ্যাওলা বাড়ায়।
তবু আজ মরীয়া হয়েই সমীরণ মাংসের দোকানে এল, আসল কারণ হল সেই হুঁকো। মাংসের দোকানের এক পাশ দিয়ে সরু গলির শেষ প্রান্তে উঁকি দিয়ে সমীরণ যুগপৎ পুলকিত ও আশ্বস্ত হল। দোকানটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, বহুকালের পুরনো মলিন, ভাঙা সাইনবোর্ড একটু ঝাঁপসা, ঝুরঝুরে হয়ে গেছে, কিন্তু পড়া যাচ্ছে:
খাঁটি তামাকের দোকান
প্রোঃ বিপুলবিহারী পাল
মিহিমোটা, তাম্বুরী দা-কাটা
রংপুর, দিনাজপুর, দিনহাটা স
কল প্রকার খাঁটি সুপেয় তামাকুর
একমাত্র বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠান।
সাইনবোর্ডের দুপাশে তামাকপাতার ছবি। সে ছবির সবুজতা এতকাল পরে বিবর্ণ কিন্তু চেষ্টা করলে, বুদ্ধি করে তাকিয়ে দেখলে ভাঙা ফ্রেম, মরচে ধরা সাইনবোর্ডের মধ্যে বাঁয়ে ডাইনে দুদিকে দুপাশে দুটো তামাকপাতা অনুমান করা যাচ্ছে।
তার চেয়েও সুখবর হল এতদূর থেকে দেখা যাচ্ছে ওই সাইনবোর্ডের অন্তর্গত দোকানটিও খোলা রয়েছে।
.
কিন্তু আরেকবার স্বপ্নভঙ্গ হল সমীরণের।
মাংস কেনা হয়ে যাওয়া মাত্র সে দ্রুতপদে হেঁটে খাঁটি তামাকের দোকানের সামনে গেল, তারপর একটা সংক্ষিপ্ত চালাকি করল, সেই দোকানের অতিবৃদ্ধ দোকানিকে সম্বোধন করে বলল, দাদু একশো গ্রাম দাকাটা তামাক দিন।
দোকানদারের পাশে বসে এক যুবক তখন সত্যিই দা দিয়ে তামাকপাতা কাঠের ওপরে ফেলে কুচিকুচি করে কাটছিল। কিন্তু বাদ সাধলেন বৃদ্ধ, এই বয়েসেও তার কান মানে শ্রুতিশক্তি খুব খরখরে। তিনি সমীরণকে বললেন, কী বললেন, দাকাটা তামাক?
সমীরণ বললেন, হ্যাঁ।
বৃদ্ধ দোকানদার বললেন, দাকাটা তামাক কেন, আজ পনেরো বছর, শ্যামাদ ব্যানার্জি লেনের গুরুপদ ডাক্তার মরে যাওয়ার পরে আমরা কোনও তামাকই বেচিনি, বেচতে পারিনি, ওই গুরুপদ ডাক্তারই ছিল আমাদের শেষ খদ্দের।
বিভ্রান্ত সমীরণ জিজ্ঞাসা করল, তাহলে এগুলো কী? এই যে দা দিয়ে কুচিকুচি করে কাটছে?
বৃদ্ধ বললেন, এগুলো হল খইনি।
সমীরণ বলল, এগুলো হুঁকো দিয়ে খায় না?
মলিন হাসি হেসে বৃদ্ধ দোকানদার বললেন, কতদিন পরে হুঁকো কথাটা শুনলুম। হুঁকো কোথায়? খইনি খেতে হুঁকো লাগে না। স্রেফ চুন দিয়ে ডলে ঠোঁট আর দাঁতের ফাঁকে ঢেলে দিলেই হল।
অতঃপর সমীরণ বাড়ি ফিরল।
কিন্তু সে এখনও হাল ছাড়েনি।
সেদিন মধ্যাহ্নে অসম্পূর্ণ দিবানিদ্রা সেরে সে হুঁকোর কথা ভাবতে বসল। কিছুক্ষণ ভাবনাচিন্তার পর তার মনে পড়ল সোনাকাকার কথা।
সোনাকাকা সমীরণের বাবার সেজভাই। ঠাকুরদার মৃত্যুর সময় তিনি দেশেই ছিলেন। ফলে ঠাকুরদার মৃত্যুর পরে দেশের শূন্য বাড়ির যা কিছু জিনিসপত্র সোনাকাকাই সঙ্গে নিয়ে আসেন এবং সবই নিজে রেখে দেন, অন্য ভাইদের কোনও ভাগ দেননি। এ নিয়ে সমীরণের বাবা বেঁচে থাকতে সমীরণের বাবা এবং অন্যান্য ভাইদের সঙ্গে সোনাকাকার বেশ বাদবিসম্বাদ হয়েছে।
সমীরণেরও একটা ব্যাপার আছে এর মধ্যে। ঠাকুরদার একটা সোনার পার্কার কলম ছিল। ঠাকুরদা বেঁচে থাকতে সমীরণকে বলেছিলেন, আমার মৃত্যুর পরে এই কলমটা তুই পাবি। তোকে দিয়ে যাব।
অবশ্য সেই কলমটাও সোনাকাকা সমীরণকে দেননি। নানা ভাবে কৌশল করে এড়িয়ে গেছেন। এক সময়ে সেই কলম পাওয়ার জন্যে অনেক হাঁটাহাঁটি করেছে সে। তখন সমীরণ সোনাকাকার বাসায়। গেলেই ও বাসার সবাই ভাবত সমীরণ কলম চাইতে এসেছে, এমনকী বিজয়া বা নববর্ষের পরে হলেও, ফলে অভ্যর্থনা তেমন মধুর হত না।
আজ প্রায় দশ-পনেরো বছর সমীরণ সোনাকাকার বাসায় যায় না। কিন্তু এবার কলমের জন্যে নয়, সে ভাবল ঠাকুরদার হুঁকো-গড়গড়া হয়তো সোনাকাকার কাছে থাকতে পারে।
অনেকে দোনামনা করে অবশেষে সাহসভরে সমীরণ একদিন অফিস ফেরতা সোনাকাকার ওখানে চলে গেল। সোনাকাকা এখন অনেক নরম হয়েছেন, বুড়ো হয়েছেন। বিগতদার, দুই মেয়েরই বিয়ে হয়ে গেছে, একই ছেলে, সেও প্রবাসী, আমেরিকায় লস এঞ্জেলসে থাকে। দু-চার বছরে একবার বাড়ি আসে। শূন্যগৃহে সোনাকাকা একা।