গলির মোড়ে পাড়ার ক্লাবে কয়েকজন প্রৌঢ় অফিস-কাছারি থেকে বাড়ি ফিরে সন্ধ্যার সময় তাস খেলেন। তাঁরা অভিজ্ঞ, প্রবীণ ব্যক্তি। সমীরণ ভাবল এঁদের কাছে হুঁকোর খোঁজ নেওয়া যেতে পারে।
সমীরণ এ ক্লাবের সদস্য নয়, কোনওদিনই এই ক্লাবে যায় না; আর ওই যাঁরা সন্ধ্যার পর ক্লাবে বসে তাস খেলেন তাদের সঙ্গে পাড়াপ্রতিবেশী সূত্রে যাকে বলে মুখচেনা আলাপ। এঁদের কারও নাম ভাল করে জানে না সে।
তবু ছেলের জন্যে সমীরণ এর মধ্যে একদিন অফিসফেরতা ক্লাবে ঢুকল। চারজন গভীর অভিনিবেশ সহকারে তাস খেলছেন, কোনও দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। টিমটিমে একটা পঁচিশ পাওয়ারের বালবের আলোয় পুরনো ছেঁড়া শতরঞ্চির ওপরে জমে উঠেছে খেলা। যতক্ষণ খেলা চলছিল তারা একজনও সমীরণের দিকে দৃষ্টিপাত করলেন না। তাস খেলার সময় বাইরের লোকের অনুপ্রবেশ তাপুড়েরা মোটেই বরদাস্ত করতে চায় না।
যা হোক খেলা এক হাত শেষ হওয়ার পর এঁদের মধ্যে একজন সমীরণের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন। ভরসা পেয়ে সমীরণ জিজ্ঞাসা করল, আপনারা কেউ হুঁকো খান কি না?
ততক্ষণে পরের দানের তাস বাটা হয়ে গেছে। ভদ্রলোক বাঁ হাত তুলে ইঙ্গিতে সমীরণকে মৌন থাকতে বলে তাস তুলে সাজাতে লাগলেন। প্রথমে থেমে থেমে গভীর চিন্তা করে টু হার্টস, টু নো ট্রামপস… ইত্যাদি ডাক চলল, তারপর তাস পেটাপেটি। আরেক ডিল খেলা শেষ হতে দশমিনিট লাগল। সমীরণ আর কী করবে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল।
ডিল শেষ হতে সেই ভদ্রলোক সমীরণকে তার প্রশ্নের খেই ধরে বললেন, হুঁকো? তিনি এর বেশি বলতে পারলেন না, কারণ এবারে তাঁর তাস বাটার পালা পড়েছে।
ফলে ওই প্রশ্নের মুখে সমীরণের আরও দশ মিনিট দাঁড়াতে হল। অবশেষে প্রায় দেড়ঘণ্টা পরে ওই চারজনের পক্ষে সমীরণকে যা জানানো হল তার সারমর্ম হচ্ছে, না আমরা হুঁকো খাই না। কোনওদিন খাইনি। আমাদের চোদ্দোপুরুষে কেউ কোনওদিন খায়নি৷তাসের লোকদের বাঁকা হাসি টপকিয়ে অপমানিত সমীরণ ক্লাবঘর থেকে বেরোতে বেরোতে শুনতে পেল চারজনের মন্তব্য,
(ক) হুঁকো?
(খ) খুব গরম পড়েছে।
(গ) ছেলে ছোকরাদের মাথা খারাপ হচ্ছে।
(ঘ) ভাগ্যিস কামড়ায়নি৷…
০৪. কোথাও পাবে না তাকে
হুঁকোর ব্যাপারটা যে এত গোলমেলে তা সমীরণ মোটেই বুঝতে পারেনি। আন্দাজ করতেও পারেনি। ক্রমশ সে অভিজ্ঞ হতে লাগল। অফিসে, পাড়ায়, আড্ডায় আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আলোচনা করে হুঁকো বিষয়ে অনেক কিছু জানতে পারল সে, যদিও কেউ তাকে হুঁকো দেখাতে পারল না।
জানা গেল, হুঁকো একরকম নয়, নানা রকম।
যথা থেলো হুঁকো, ডাবা হুঁকো, আলবোলা, গড়গড়া, ফরাসি, সটকা। একেক হুঁকো একেক রকম দেখতে। সমীরণ সমস্যায় পড়ল, তা হলে মিড়নের হুঁকোমুখো হ্যাংলা ঠিক কী জাতের হুঁকোর মতো দেখতে ছিল?
অবশ্য এটা একটা কাল্পনিক সমস্যা। কারণ কোনও রকম হুঁকোই এ পর্যন্ত তার চক্ষুগোচর হয়নি, যেটা দেখিয়ে শ্রীমান মিড়নকে বলা যায়, দ্যাখো, এই হল হুঁকো, তোমার বইয়ের ছড়ার হ্যাংলা লোকটার মুখ এই রকম দেখতে।
সে ধরনের পজিটিভ কিছু অদ্যাবধি বলার সুযোগ হয়নি সমীরণের কিন্তু শ্রীমান মিড়ন প্রতিদিন, প্রত্যহ সমীরণ অফিস থেকে ফিরে আসামাত্র জিজ্ঞাসা করছে, বাবা, হুঁকো?
মিড়নের মা, ওই শ্যামলী আজকাল আর এ ব্যাপারটাকে তেমন গুরুত্ব দিচ্ছে না। বোধহয় সয়ে গেছে কিংবা বুঝে গেছে।
কিন্তু সমীরণের তো সয়ে যায়নি। ছেলেকে হুঁকো দেখাবে সে বলেছে, সুতরাং তাকে দেখাতেই হবে। সে কোনও যা-তা বাবা নয়।
এর মধ্যে একটা অসামান্য সুযোগ জুটে গেল।
সমীরণের অফিসের এক সহকর্মী, প্রায় তারই সমবয়সি, দুজনে একই বছরে কাজে ঢুকেছিল, পাশাপাশি টেবিলে বহুদিন কাজ করেছে সেই অরুণকান্ত, সম্প্রতি একটু মোটা হয়ে পড়েছিল, এই বয়েসেই একটু থপথপে। অফিসে আসার মুখে সে সিঁড়ির ওপরে মুখ থুবড়ে পড়ে মারা গেল। অফিসের ডাক্তার বললেন, ম্যাসিভ হার্ট স্ট্রোক (Massive Heart Stroke)।
সেদিনই বিকেলে অরুণের শেষকৃত্যে যেতে হল নিমতলায়। নিমতলা শ্মশানঘাট থেকে বেরিয়ে সামনের রাস্তায় একটু ঘোরাঘুরি করছিল সমীরণ। সাধারণত শ্মশানে সে আসে না, শ্মশানঘাটের দৃশ্য তার ভাল লাগে না। কিন্তু সামাজিক জীব হিসেবে বাধ্য হয়ে আসতেই হয়। তা ছাড়া পুরনো সহকর্মীর মৃত্যু, একটা দায়িত্বও তো আছে!
শ্মশানের বাইরের রাস্তায় সন্ন্যাসী, ভিখিরি আর ভবঘুরেরা ইতস্তত বসে রয়েছে। মিষ্টির দোকান, চায়ের দোকান, ফুল-বেলপাতার দোকান এরই মধ্যে একটা মুদিখানা, শ্মশানেও। মুদিখানা, খুব দুঃখের হাসি পেল সমীরণের এবং তখনই তার চোখে পড়ল পাশে পরপর দুটো কলকের দোকান।
একেবারে হাতে চাঁদ পেল সমীরণ। বন্ধু অরুণকান্ত মরে তাকে বাঁচিয়ে গেল। কলকের দোকানে নিশ্চয়ই হুঁকো থাকবে, হুঁকো না থাকলেও হুঁকোর খোঁজ পাওয়া যাবে।
কিন্তু, হায় হতভাগ্য, এবারেও সমীরণকে নিরাশ হতে হল।
দোকানদার বলল, না হুঁকো নেই। এগুলো তামাক খাওয়ার কলকে নয়। এগুলো হাসিস, চরস, গাঁজা খাওয়ার কলকে। ওসব খাওয়ার জন্যে হুঁকো লাগে না। কলকে থেকে সরাসরি টানতে হয়।
দোকান ভর্তি কলকে আর কলকে। শুধুই কলকে। সেদিকে তাকিয়ে সমীরণ বলল, আপনারা শুধু কলকে বেচেন। শুধু কলকে বেচে দোকান চলে?