কী ভয়ানক! এই রকম দরকারি খাতায় ছেলের মনোরঞ্জনের জন্যে সমীরণ ছবি আঁকছে, তাও কি হুঁকোর ছবি। এরপর অধঃপতনের অতল সলিলে ডুবে যেতে ছেলের আর কয় ধাপ নামতে হবে?
শ্যামলী এতই উত্তেজিত হয়ে পড়ল যে সমীরণ তাকে কিছুতেই বুঝিয়ে উঠতে পারল না যে ভূগোল না হোক সে ছেলেকে অন্তত ব্যাকরণ শেখাচ্ছিল। আর ওটা ঠিক হুঁকোর ছবি নয়, হুঁকোর ছবি সে এখনও আঁকেনি এবং তার সন্দেহ হচ্ছে সে হয়তো ভাল ভাবে এঁকে উঠতে পারবে না।
শ্যামলী চেঁচিয়ে জানতে চাইল, তবে যে তুমি বললে হুঁকো?
সমীরণ বলল, ঠিক হুঁকো নয়, ছবিটা ভাল করে লক্ষ করো, ওটা হল ধোঁয়ার ছবি, হুঁকোর কলকের ধোঁয়ার ছবি।
সে যে আরও খারাপ ব্যাপার। শ্যামলী আর্তনাদ করে উঠল। প্রত্যেকদিনই স্নান করার পর শ্যামলীর গলা কিছুক্ষণের জন্য একটু বসে যায়, ফলে আর্তনাদ তেমন জমল না কিন্তু এতে সে দমল না, সমীরণের কাছে জানতে চাইল, হুঁকোর কলকের ধোঁয়ার সঙ্গে ব্যাকরণের সম্পর্ক কী? এর মধ্যে ব্যাকরণ কোথা থেকে আসে?
এই দাম্পত্যকলহের বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে লাভ নেই। ব্যাপারটা রুচিসম্মত নয়, এর মধ্যে কোনও অভিনবত্বও নেই।
সুতরাং সংক্ষিপ্ত করে বলি, সমীরণ এরপর হুঁকোর ছবি আঁকা থেকে নিবৃত্ত হল।
০৩. হুঁকোর সন্ধানে
আজকের সকালের ঘটনার আকস্মিকতায় বহু অভিজ্ঞ শ্রীমান মিড়নও কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিল।
ভূগোলের খাতা থেকে ধূমজাল কলঙ্কিত পৃষ্ঠাটি পরিচ্ছন্নভাবে নিশ্চিহ্ন ও কুচিকুচি করে ফেলে শ্যামলী যখন পাশের ঘরে অন্য একটা পাখা খুলে চুল শুকোতে গেল মিড়ন থতমত স্বরে জিজ্ঞাসা করল, বাবা, হুঁকো জিনিসটা খারাপ?
সমীরণ এ প্রশ্নের আসল উত্তর না দিয়ে ছেলেকে সান্ত্বনার ভাষায় বলল, আমি তোমাকে হুঁকো দেখাব। দেখলেই বুঝতে পারবে জিনিসটা ভাল কি খারাপ?
মিড়ন বলল, মা দেখলে বুঝতে পারবে?
সমীরণ বলল, তোমার মা-র হুঁকো দেখার দরকার নেই। তোমার মায়ের মামারা ছিলেন এক নম্বরের হুঁকোখোর। সারাদিন তিন মামা গুড় গুড় গুড় গুড়, লম্বা নলে গড়গড়ায় টান দিয়ে যাচ্ছেন আর টান দিয়ে যাচ্ছেন।
এই রকম তিক্ত কথা বলার পরে সমীরণের যৌবন-বেদনা ফিরে এল। মনে পড়ল নববিবাহের সুখস্মৃতি। দ্বিরাগমনের অব্যবহিত পরে এক রবিবারে বারুইপুরে শ্যামলীর মামার বাড়িতে যেতে হয়েছিল। সে বাড়িতে গিয়ে তার মনে হয়েছিল এ বাড়িতে তামাক সাজা আর তামাক পান করা, পান সাজা আর পান খাওয়া ছাড়া কারও কোনও কাজ নেই।
মনে আছে, পৌঁছানোর পরে চা-জলখাবার শেষ করে সে উঠল গিয়ে দোতলায় চিলেকোঠা ঘরে। একতলা বাড়ির দোতলায় চিলেকোঠা বিরাট ব্যাপার, বিরাট লম্বা-চওড়া ঘর, অনন্ত ছাদ। ছাদের পাশে নারকেলের গাছের সারি, ছাদের কার্নিশে অফুরন্ত কচি নারকেলের বোঝা নামিয়ে গাছগুলো বিশ্রাম করছে। কোনও কোনও নারকেল গাছের বুকে মঞ্জরী এসেছে, ঈষৎ সাদা হলদেটে কুসুমগুচ্ছ, কেমন যেন মনে হয়েছিল ক্ষীণ গন্ধও আছে সেই সব মঞ্জরীতে।
চিলেকোঠার ছাদে আসার কয়েক মুহূর্তের মধ্যে জনৈক নবকিশোরী শ্যালিকা এসে তাকে জিজ্ঞাসা করল, জামাইবাবু, হাবল বাবল?
হাবল বাবল শব্দটা কেমন যেন চেনা চেনা মনে হচ্ছিল সমীরণের কিন্তু সে কিছু বলার আগেই সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে এল ধূমায়িত অম্বুরী তামাকের নল-গড়গড়া হাতে এক সোমত্তা, সুরসিকা দাসী।
সেই মুহূর্তে সমীরণের মনে পড়ছিল, হুঁকোর ইংরেজি হল হাবল বাবল। তখন কড়া চার্মিনার সিগারেট খায় সমীরণ। তার বদলে সেই অম্বুরী তামাক, কী যে ভাল লেগেছিল সমীরণের।
কিন্তু এসব কথা ভেবে এখন লাভ নেই। তার চেয়ে বড় কাজ হল ছেলেকে একটা হুঁকো দেখানো, যেটা দেখলেই মিড়ন বুঝতে পারবে হুঁকোমুখো মানে কী। সেটাই হবে হাতে কলমে শিক্ষা। মিড়নের ক্লাসের অন্য কোনও ছেলেই জানতে পারবে না হুঁকোমুখো কী রকম। এই প্রতিযোগিতার বাজারে সেটা কি কম কথা।
সুতরাং সমীরণ মিড়নের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হল সে তাকে হুঁকো দেখাবে।
এইখানেই সমীরণ ভুল করে বসল। তার ধারণা হয়েছিল আশেপাশে, নিশ্চয়ই পাড়ার মধ্যেই এখনও কেউ না কেউ হুঁকো খায়; একটু চেষ্টা করলেই মিড়নকে নিয়ে গিয়ে সে হুঁকো দেখিয়ে আনতে পারবে। হয়তো ঠিক হুঁকো যাকে বলে তা হবে না সেটা, গড়গড়া হওয়াই সম্ভব।
কিন্তু কার্যত দেখা গেল হুঁকো দর্শন এখন আর সহজ নয়। শুধু নিজের পাড়াতেই নয়, চার দিকে দু-চার-দশ কিলোমিটারের মধ্যে কোনও কোপায়ীর সন্ধান পেল না সমীরণ। সকলের অগোচরে কবে যে হুঁকো-গড়গড়া অবলুপ্ত হয়ে গেল।
অথচ সমীরণের প্রথমে মনে হয়েছিল এই তো সেদিনও যেন কোনও বাড়ির বারান্দায় কোনও এক বুড়োকে সে হুঁকো খেতে দেখেছে। কিন্তু বোঝা গেল এটা মনের বিভ্রম মাত্র। সেই সব কোসেবী মানুষেরা পৃথিবী থেকে কবে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
প্রথম কয়েকদিন সমীরণের আশা ছিল হয়তো পথেঘাটে, এখানে ওখানে সহসা তেমন কাউকে দেখতে পাবে যে কিনা হুঁকো হাতে প্রসন্নচিত্তে একগাল ধোঁয়া ছাড়ছে।
তা হলেই, কেল্লা ফতে। সঙ্গে সঙ্গে বাড়িতে ছুটে গিয়ে মিড়নকে নিয়ে এসে হুঁকোটা দেখিয়ে নিয়ে যাবে।
কিন্তু, তা কি আর হয়। একটা হুঁকোও সতত সন্ধানী সর্তক সমীরণের দৃষ্টিগোচর হল না।