সমীরণ খবরের কাগজের বোঝা টেবিলের ওপরে ফেলে টেবিলের ওপ্রান্তে সোফায় ছেলের পাশে বসে তার হাতের বইখানা তুলে নিল।
বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর বাংলার পাঠ্যপুস্তক সেটা। তারই কবিতাংশে রয়েছে হুঁকোমুখো হ্যাংলা নামক সেই অত্যাশ্চর্য, অবিস্মরণীয় ছড়াটি। শ্যামাদাস নামে আফিঙের থানাদার মানে একসাইজ সাব ইন্সপেক্টরের সে ভাগ্নে, সে হুঁকোমুখো, সে হ্যাংলা, সে বাঙালি কারণ বাড়ি তার বাংলা, সব চেয়ে বড় কথা তার দুটো লেজ, কিন্তু মানুষের তো লেজ নেই, পশুদের লেজ থাকলেও মাত্র একটা করে লেজ, পাখিদের, সাপেদের, টিকটিকিদের, মাছেদেরও মাত্র একটাই লেজ, সেদিক থেকে হুঁকোমুখো হ্যাংলা সকলের চেয়ে এক ডিগ্রি অথবা একশো ডিগ্রি ওপরে।
দু-লেজের একটা কিস্তৃত জন্তু, যে কখনও হাসে না, যার শুধু এক আবগারির দারোগামামা ছাড়া কেউ নেই শিশুচিত্রের কল্পনার জন্যে অসামান্য, অতি, অতিশয় চমৎকার একটি জানোয়ার।
কিন্তু আধুনিক বিদ্যালয়ের শিশুদের পাঠক্রমে কোনও কল্পনাবিলাসের অবকাশ নেই, অতএব হালকা জিনিস চলবে না।
হুঁকোমুখো হ্যাংলা ছড়াটির ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত, সামাজিক ভূমিকা, নান্দনিক গঠনরীতি, আর্থ রাজনৈতিক বিশ্লেষণ এমনকী সমকালীন বিশ্বসাহিত্যের পটভূমিকায় ছড়াটির যৌক্তিকতা– চতুর্থ শ্রেণীর শিশুদের সবই জানতে হবে। আর শুধু তাই নয়, ব্যাকরণগত যা কিছু প্রশ্ন ওই ছড়ায় নিহিত রয়েছে সেটাও অনুধাবন করতে হবে।
সেই অনুধাবন করতে গিয়েই ছড়াটির প্রথম শব্দেই ব্যাকরণের ধাক্কায় আটকে গেছে শ্রীমান মিড়ন।
হুঁকোমুখো সমাসবদ্ধ পদ, ঠিক আছে মেনে নিয়েছে মিড়ন, ব্যাসবাক্য হল হুঁকোর মতো মুখ যাহার বা যাহাদের, তাতেও আপত্তি নেই মিড়নের। কিন্তু হুঁকো জিনিসটা কী?
তাই তার সরল ও স্বাভাবিক প্রশ্ন, বাবা, হুঁকো কী?
সমীরণ সে জাতের বাবা নয় যে, হুঁকো জিনিসটা কী তা তোমার না জানলেও চলবে, এই রকম গুরুগম্ভীর জবাব দিয়ে প্রশ্নটার পাশ কাটিয়ে যাবে। সুতরাং সে একটু ভেবে চিন্তে সমঝিয়ে তারপর উত্তর দিল, হুঁকো দিয়ে তামাক খায়, তামাক খাওয়ার জিনিস একটা।
মিড়ন বলল, সিগারেটের মতো?
সমীরণ বলল, আরে না। না। মোটেই সিগারেটের মতো নয়। হুঁকো অনেক বড়, হুঁকোর মধ্যে জল থাকে। সিগারেটে তামাক কাগজ দিয়ে জড়ানো থাকে। আর হুঁকোয় তামাক এমনিই থাকে। কোর তামাকের গন্ধ খুব ভাল হয়।
এ কথা বলতে বলতে সমীরণের স্মৃতি তিরিশ বছর পিছিয়ে গেল। তখনও দেশের বাড়িতে ঠাকুরদা বেঁচে। বিকেলে বাইরের বারান্দায় জলচৌকিতে বসে গড়গড়া টানতেন, উঠোনের এক প্রান্তে গন্ধরাজ লেবুর পুরনো ঝাড়ে সাদা ফুলে আর কলিতে থই থই করছে সৌরভ, বারান্দায় উঠে আসছে সেই গন্ধ তার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে দাকাটা তামাকের ধোঁয়ার ঘ্রাণ। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বুক ভরে একটানা হাওয়া টানল সমীরণ, সুখস্মৃতির সঙ্গে পুরনো দিনের সৌরভ যদি একটু ফিরে পাওয়া যায়।
বাদ সাধল মিড়ন, সে তো আর তার পিতৃস্মৃতির অংশীদার নয়, এটা তার জিজ্ঞাসার বয়েস, তার জিজ্ঞাসা অফুরন্ত, সে জিজ্ঞাসা করল, বাবা, তাহলে কি সিগারেটের মতো হুঁকো দিয়ে ধোঁয়া বেরোয়?
স্মৃতিজাল ছিন্ন করতে করতে সমীরণ বলল, তা বেরোবে না কেন?
মিড়ন বলল, কিন্তু বাবা তুমি যে বললে হুঁকোয় জল থাকে।
সমীরণ বলল, থাকে তো, কিন্তু তাতে কী হয়েছে?
মিড়ন বলল, জলে আগুন নিবে যায় না? তাহলে ধোঁয়া বেরোয় কী করে?
সমীরণ বুঝতে পারল হুঁকো জিনিসটা যে দেখেনি তার পক্ষে বোঝা কঠিন, বিশেষ করে একটি শিশুর পক্ষে। কলকে থেকে নলচে পর্যন্ত সে এক এলাহি কারবার। উঠে গিয়ে ছেলের টেবিল থেকে একটা খাতা পেনসিল নিয়ে এসে হুঁকোর ছবি আঁকতে বসল সমীরণ। তার পাশে মিড়ন উগ্রীব হয়ে তাকিয়ে।
সমীরণ প্রথমে আঁকল ধোঁয়া, নীচে থাকবে কলকে, কলকের ভেতর থেকে তামাকের ধোঁয়া বেরোচ্ছে।
ধোঁয়া আঁকা খুব সোজা, খুব সহজেই ধোঁয়া আঁকার ব্যাপারটা সেরে ফেলল সমীরণ, তবে মিড়নের প্রতিক্রিয়া সুবিধের নয়, সে বলল, বাবা, মেঘ আঁকছ? ওই মেঘের জল দিয়ে হুঁকো হবে?
সমীরণ কিছু বোঝানোর আগেই সকালবেলার স্নান সেরে এলোচুল ঝাড়তে ঝাড়তে বাইরের ঘরের পাখার নীচে সিক্ত কেশরাজি শুকোনোর জন্যে শ্যামলী প্রবেশ করল অকুস্থলে।
বাইরের ঘরে ঢুকেই সে চেঁচামেচি শুরু করল, সর্বনাশ! ছেলের ইস্কুলের খাতায় এসব কী হাবিজাবি কাটাকুটি করছ? এ খাতা নিয়ে কাল ইস্কুলে যাবে কী করে?
হুঁকোর ধোঁয়ার ছবি আঁকা থামিয়ে ছেলের সরল প্রশ্নের আগে স্ত্রীর কঠিন প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত জবাব দিল সমীরণ, হুঁকোর ছবি আঁকছি।
শ্যামলীর চুল ঝাড়া বন্ধ হয়ে গেল, চোখ বিস্ফারিত হল।
ইস্কুলের পবিত্র খাতায় হুঁকোর ছবি! তা ছাড়া এই হাসিস, চরস, ড্রাগের দুর্দিনে বাপ নিজে কিনা ছেলেকে, একমাত্র ছেলেকে, হুঁকোর ছবি এঁকে দেখাচ্ছে। বিয়ের পর থেকেই শ্যামলীর কোনও এক অনির্দিষ্ট কারণে মনে বদ্ধমূল ধারণা জন্মেছিল একদিন তার স্বামী সমীরণ তার সমূহ ক্ষতি, চূড়ান্ত বিপর্যয় ঘটাবে। আজ এই মুহূর্তে শ্যামলী এ ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হল।
এক ছোঁ মেরে সে স্বামীর হাত থেকে ছেলের ইস্কুলের খাতা ছিনিয়ে নিল। সর্বনাশ, এ যে ভূগোলের খাতা, সাধারণ খাতা নয়, ল্যাবরেটরি নোট বুক। ভূগোলের অবশ্য ল্যাবরেটরি নেই কিন্তু ওই নোটবুকটা লাগে। বাঁয়ে সাদা পৃষ্ঠা, ডাইনে লাল মার্জিনে নীল রুল টানা পৃষ্ঠা। এই পৃষ্ঠায় মানচিত্র, প্রয়োজনীয় ছবি আঁকতে হয়, ওই পৃষ্ঠায় আক্ষরিক বর্ণনা।