কিন্তু বাদ সাধল সমীরণের ইতিহাসবোধের অভাব। মীরণ নামটা ইতিহাস কুখ্যাত মিরজাফরের ছেলের নাম, বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজদ্দৌলাকে সে হত্যা করেছিল, যা তা হত্যা নয় রীতিমতো গলা কেটে হত্যা এবং সেই মীরণ নিজেই একদিন বজ্রাঘাতে মারা গিয়েছিল।
তবে এসব কূট প্রশ্ন প্রথম দিকে ওঠেনি। সমীরণ-মীরণ ভালই চলে যাচ্ছিল। কিন্তু বছর কয়েক আগে পুজোর সময় সপরিবারে দিল্লি বেড়াতে গিয়ে খুড়শ্বশুরের বাড়িতে উঠেছিল সমীরণ, সেখানে প্রশ্নটা ওঠে; খুড়শ্বশুর মানে সমীরণের স্ত্রী তথা মীরণের মা শ্যামলীর কাকা।
খুড়শ্বশুর ভদ্রলোক কিঞ্চিৎ প্রাচীনপন্থী, দিল্লির একটা কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক। তিনি নাতির নাম মীরণ শুনে পৌঁছানোর দিনই সন্ধ্যাবেলা সমীরণ ও শ্যামলীকে বাংলার ইতিহাসের কিঞ্চিৎ ব্যাখ্যা করলেন। এবং বললেন, কোনও ভারতীয়ের নামই মীরণ রাখা উচিত নয়।
কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। সে সময় মীরণের বয়েস সাত। চার বছর বয়েসে মীরণকে স্কুলে নার্সারিতে ভরতি করা হয়েছে, তখন থেকে মীরণ নীমটা চলেছে। নামটা চালু হয়ে গেছে, স্কুলের খাতায় নাম রেকর্ড হয়ে গেছে। এরপর নাম পালটানো খুবই ঝামেলা।
যথাসময়ে সমীরণ শ্যামলীরা ছুটির অবসানে কলকাতায় ফিরে এল। কিন্তু দুজনের মনের মধ্যেই ছেলের নাম নিয়ে একটা খুঁতখুঁতানি ভাব। অনেক ভেবে চিন্তে অবশেষে সমীরণ তার কলেজের সহপাঠী বন্ধু অনিমেষকে ধরল।
অনিমেষ খবরের কাগজের অফিসে কাজ করে। একসময় ভারী ভারী প্রবন্ধ লিখত, এখন শুধুই চাকরি করে আর আড্ডা দেয়। তবে বাংলাটা মোটামুটি জানে।
অনিমেষকে গিয়ে সমস্যাটা বলতে সে প্রথমে একচোট খুব হাসল, তারপর বলল, এই আধুনিক নাম রাখার ব্যাপারটা বেশ গোলমেলে হয়ে দাঁড়িয়েছে। রবীন্দ্রনাথ থেকে ব্যাপারটা শুরু হয়েছে। লোকেরা নবজাতকের নাম ওঁর কাছে চেয়ে পাঠাত। এখন তো যে কেউ নামকরণ করছে। অর্ধেক সময় তো নামের কোনও মানেই করা যায় না।
সমীরণ বলল, কিন্তু কী করা যাবে?
অনিমেষ বলল, আর রবীন্দ্রনাথ যে নামকরণগুলো করেছিলেন সেগুলোর তো মানে ছিল, অর্থ ছিল। তার মধ্যে কাব্যও ছিল।
এভাবে কিছুক্ষণ আলোচনা চলার পর অনিমেষ বলল, দাঁড়া, দুচারদিন সময় দে। আমি একটু ভেবে দেখি।
কয়েকদিন পরে অনিমেষ সমীরণকে অফিসে ফোন করে বলল যে, সে একটা সমাধান পেয়েছে, খুব সহজ সমাধান। সেদিনই বিকেলে ছুটির পরে অনিমেষের সঙ্গে সমীরণ দেখা করল।
অনিমেষ যে পরামর্শ দিল সেটা বেশ গ্রহণযোগ্য। মীরণ নামটা বদলাতে হবে না, শুধু বানানটা বদলাতে হবে। মীরণ বদলিয়ে মিড়ন হয়ে যাবে।
এবার সমীরণ জিজ্ঞাসা করল, কিন্তু মিড়ন মানে কী?
অনিমেষ বলল, সংগীতের সেতারের মিড় আছে না, স্বর ওঠে নামে, সেই মিড় থেকে মিন,কম্প থেকে যেমন কম্পন।
বিনা বাক্যব্যয়ে সমীরণ অনিমেষের এই সমাধান মেনে নিল। তবে অনিমেষ বলে দিল, মিড়ন বানানে প্রথমে হ্রস্ব ইকার হবে, দীর্ঘ ঈকার নয়। আর শেষেরটা দন্ত্য ন, মূর্ধন্য ণ নয়।
অতঃপর মীরণ মিড়ন হয়ে গেল।
.
এখন মিড়নের বয়েস নয়। তার নাম সবার অলক্ষ্যে সংশোধন করা হয়েছে। ক্লাসে কেউ টের পায়নি, টের পাওয়ার কথাও নয়, বাচ্চা ছেলের নামের বানান নিয়ে কেই বা মাথা ঘামায়।
তা না ঘামাক। এ গল্প মোটেই মিড়নকে নিয়ে নয়। এ গল্প হুঁকো নিয়ে। আর হুঁকো, অর্থাৎ তামাক সেবনের সেই প্রাচীন যন্ত্র, সে তো প্রাপ্তবয়স্কের ব্যাপার, তার মধ্যে নয় বছর বয়েসের দুধের শিশুকে ডেকে আনা কেন?
০২. হুঁকোমুখো হ্যাংলা
যদিও ক্লান্তি আর একঘেয়েমির প্রশ্নটা আছে, থেকেই যায়, তবু হাসির গল্প ছড়িয়ে ছিটিয়ে লিখলে ভাল হয়, কিছু রাখাটাকা করতে নেই।
সেই জন্যেই গল্পের গোড়াতে মীরণ-মিড়ন উপকাহিনিটি বলে নিলাম। তা ছাড়া একটু পরেই বোঝা যাবে এই হুঁকোকাহিনির মূল নায়ক হল ওই নয় বছর বয়েসি মিড়ন, যে মিড়ন একটি আধুনিক বিদ্যালয়ে ক্লাস ফোরে পড়ে।
মিড়নের পড়াশুনোর দিকে নজর রাখছিল সমীরণ, আজ এই ছুটির দিনের সকালে চা খেতে খেতে খবরের কাগজ পড়ার ফাঁকে ফাঁকে।
একদিনের ম্যাচে সদ্য নির্বাচিত ভারতীয় ক্রিকেট টিমের সর্বশেষ তালিকাটি খুঁটিয়ে দেখছিল সমীরণ, বিশেষ মনোযোগ সহকারে। আজাহারউদ্দিন আর শচীন তেন্ডুলকার, দুজনের ওপরেই সমীরণের প্রচুর আস্থা, কিন্তু হাজার হলেও খেলাটা ক্রিকেট, কখন কীসে কী হয় কিছুই বলা যায় না।
এমন সময় ক্রিকেট তালিকায় সমীরণের মনোযোগ ও একাগ্রতা ছিন্ন করে মিড়ন জিজ্ঞাসা করল, বাবা, হুঁকো কী?
হঠাৎ এই প্রশ্নের ধাক্কায় বাংলা সিনেমার নায়কের মতো অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে সমীরণ বলতে যাচ্ছিল, হুঁকো, ওই হুঁকো আর কী?
এবং সেই মুহূর্তেই তার খেয়াল হল তার ছেলে মিড়ন হয়তো হুঁকো জিনিসটা কখনও দেখেনি।
কিন্তু হুঁকো, হুঁকো নামক সনাতন নেশার দ্রব্যটি ইস্কুলের নিচু ক্লাসের পাঠ্যতালিকায় কী করে আসছে? দিনে দিনে কী যে হচ্ছে সব। সমীরণের বয়েস যদিও এখন মাত্র আটত্রিশ সে ধরে নিল নয়ানীতির পাঠ্যরীতির দোষ এটা, সব গোলমেলে জিনিস শেখানো হচ্ছে শিশুদের, বালক বালিকাদের; দেশটা তুফানমেলে জাহান্নমের দিকে দ্রুত এগোচ্ছে।
আসলে ঘটনাটা কিন্তু ঠিক তা নয়। ঘটনাটা মিড়ন ও তার সহপাঠীদের পক্ষে অনেক বেশি জটিল। ও বিপজ্জনক।