রামলগন বললেন, ওসব প্রশ্ন বাদ দিন দত্তদা। ফুটনোট না দিয়ে ভূমিকা না হয় দিলেন। প্রথমে লিখে দিন এ গল্পের নায়ক হাওলা, গাওলা আর মওলা করেন।
অর্ণব দত্ত কিছুই বুঝতে না পেরে বললেন, হাওলা তো দিল্লির ব্যাপার কাগজে দৈনিক দেখছি। আর গাওলা হল গোরুর খাবার চুরি। এটা পাটনার। এ দুটো না হয় বুঝলাম। কিন্তু মওলাটা আবার কী?
রামলগন ব্যাখ্যা করলেন, মওলা হল মৌলবাদ, ওটা মুম্বইয়ের ব্যাপার, মুম্বই ব্লাস্ট তো জানেন।
চিন্তিত অর্ণব দত্ত বললেন, কিন্তু এতে আমার গল্পের নায়কের কী সুবিধে হবে?
তেওয়ারি বললেন, তার না হোক আপনার সুবিধে হবে। সে যখন হাওলা করে তখন সে পুরন্দর, যখন গাওলা করে তখন…
অর্ণব তেওয়ারিকে থামিয়ে বললেন, ও আর বলতে হবে না। কিন্তু তিন জায়গায় তিন বউয়ের কী হবে? রেলের স্টেশনগুলোর নাম না হয় কেটে ঠিক করে দিলাম।
ঠিক এই সময়ে বাধা পড়ল। নীচতলা থেকে ভাইপো ওপরে এসে বলল, জেই, এক ভদ্রমহিলা এসেছেন, বলছেন আমি তোমার জেঠিমা। বালকের কথা শেষ হওয়ার আগেই এক মধ্য বয়সিনী মহিলা অর্ণব দত্তের ঘরে প্রবেশ করলেন।
সকলেই বুঝতে পারছেন যে কাহিনি এবার নাটকীয় মোড় নিতে চলেছে। পাঠক-পাঠিকাদের অনাবশ্যক উত্তেজনার মধ্যে রাখা আমার পছন্দ নয়। অনতি অতীতের মানে এই গত চব্বিশ ঘণ্টায় দুয়েকটি ঘটনা একটু বললেই, আশা করি, উত্তেজনা প্রশমন হবে।
ডাক মারফত গতকালই রামলগন শ্রীমতী অমলিনার গল্পটি পেয়েছেন। ডাকের কোনও লেখাই রামলগন ফেলে রাখেন না। ছাপতে পারলে সঙ্গে সঙ্গে জানিয়ে দেন, ছাপতে না পারলে লেখেন, আরও ভাল লেখা দিন। আশা করি ভবিষ্যতে আপনার সহযোগিতা হতে বঞ্চিত হব না।
আসলে রামলগন জানেন যারা লেখা পাঠায় তাদের অধিকাংশই কাগজের পাঠক, তাই তিনি তাদের চটাতে চান না।
সে যা হোক, গতকালই অমলিনার গল্পটি তিনি পড়েছেন এবং নতুন লেখিকার লেখায় অসাধারণ যোশ পেয়ে চমৎকৃত হয়েছেন। তিনি তখনই অমলিনাকে চিঠি লিখে জানাতে যাচ্ছিলেন যে লেখাটি ভাল লেগেছে এবং শিগগিরই ছাপা হবে। এমন সময় অমলিনার ফোন আসে।
রামলগন অমলিনাকে বলেন যে তার লেখাটি ছাপা হচ্ছে। তখন অমলিনা তাঁকে জানান যে তিনি দুদিন আগে কলকাতায় এসেছেন, কাল দুপুরের ফ্লাইটে মুম্বই ফিরে যাচ্ছেন, যাওয়ার আগে একবার দেখা করে যেতে চান।
রামলগন তখন বলেন, কাল সকালে দেখা হতে পারে। তবে সকালে আমি অফিসে থাকি না, লেখকদের বাড়ি যাই। তারপর ডায়েরি দেখে বললেন, কাল সকাল এগারোটায় আমি গল্পকার অর্ণববাবুর বাড়িতে যাচ্ছি। আপনার সুবিধেই হবে বাড়িটা এয়ারপোর্টের পথেই, ওখানেই চলে আসুন, ঠিকানাটা নিয়ে নিন।
তখন অমলিনা প্রশ্ন করেন, অর্ণববাবু মানে কি অর্ণব দত্ত?
রামলগন বললেন, তা ছাড়া আর কী? লেখক অর্ণববাবু উনি একাই।
এবার ফোনের ওপারে অমলিনা একটু চিন্তা করলেন এবং ঠিকানাটা নিয়ে বললেন, ঠিক আছে, আমি যাব।
সেই তিনি, শ্রীমতী অমলিনা, এসেছেন।
বহুকাল হয়ে গেছে, জীবন গিয়েছে চলে কুড়ি কুড়ি বছরের পার। তবুও সাবলীলভাবে ঘরে ঢুকে অর্ণবের পাশে খাটের ওপরে বসে রামলগনের দিকে একবার তাকিয়ে বললেন, আপনি নিশ্চয় রামলগনবাবু। তারপর মুখ ঘুরিয়ে অর্ণবের দিকে তাকিয়ে বললেন, ভীষণ মুটিয়ে গেছ তুমি। একেবারে গোলগাল, নাদুসনুদুস। নামও খুব করছ শুনছি।
অমলিনার এই আকস্মিক প্রবেশে অর্ণব দত্ত যতটা বিস্মিত হয়েছেন, তার থেকে অনেক বেশি বোকা বনে গেছেন রামলগন।
রামলগন বললেন, এ কী ব্যাপার। আপনাদের পরিচয় আছে নাকি। অর্ণববাবু আপনি তো সাংঘাতিক লোক।
অর্ণব নির্নিমেষ নয়নে অমলিনার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। একটু সময়ের ছাপ পড়েছে একটু বয়েসের কারিকুরি। তবু চোখের কোনায় এখনও পুরনো দিনের বিদ্যুৎ ঝিলিক দিচ্ছে।
চোখ নামিয়ে নিয়ে রামলগনকে বললেন, ইনি আমার স্ত্রী।
স্তম্ভিত ও উল্লসিত রামলগন বললেন, এ তো রাজযোটক। বাংলা সাহিত্যে নতুন যুগ যে এসে গেল। তারপর ব্যবসায়ী বুদ্ধিবশত অমলিনাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনার প্লেন কখন? ছেড়ে যাবে না তো? অমলিনা বললেন, যাক।
হুঁকো
০১. মীরণ বনাম মিড়ন
বাবা, হুঁকো কী?
ব্যাপারটা আরম্ভ হয়েছিল এই রকম অতি সাধারণ ভাবে। কিন্তু সেটা যে শেষ পর্যন্ত এত জটিল আকার ধারণ করবে সেরকম কিছু সমীরণ ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করতে পারেনি।
সেটা কোনও এক রবিবারের সকালবেলা। সমীরণ সদ্য বাজার থেকে এসে দিনের দ্বিতীয় পেয়ালা চা নিয়ে খবরের কাগজ খুলে বসেছে।
সপ্তাহের অন্যান্য দিন সকালবেলায় অফিস যাওয়ার তাড়া থাকে। রবিবারে সে ঝামেলা নেই। রবিবারে সকালের দিকে এই বাজার যাওয়া ছাড়া আর বিশেষ কোথাও যায় না সমীরণ। ইংরেজি বাংলা দুটো খবরের কাগজ খুব মন দিয়ে খুঁটিয়ে পড়ে আর যতটুকু সম্ভব ছেলেকে পড়ায়, ছেলের পড়াশুনো দেখে।
সমীরণের একই ছেলে, মেয়ে-টেয়ে নেই। ছেলের নাম আগে ছিল মীরণ, এখন হয়েছে মিড়ন।
প্রথমটা কায়দা করে সমীরণ থেকে ছেলের নাম মীরণ রাখা হয়েছিল। এ নামটা সমীরণ কোথায় যেন শুনেছিল এবং ছেলে জন্মানোর আগেই মনে মনে ঠিক করে রেখেছিল ছেলে হলে তার নাম রাখবে মীরণ। বাপের নাম সমীরণ, ছেলের নাম মীরণ বেশ জুৎসই হবে ব্যাপারটা।