অর্ণব দত্ত বললেন, মাথা ছিঁড়ে যাচ্ছে। এদিকে আপনার গল্পটাও লেখা হয়নি।
রামলগন বললেন, আপনি ডোবালেন। একদিনে একসঙ্গে পাঁচটা কাগজ বের করতে হয়। ডেট ঠিক না থাকলে খুব গড়বড় হয়ে যায়।
অর্ণব দত্ত বললেন, গল্পটা তো লিখেছিলাম।
রামলগন চঞ্চল হয়ে বললেন, সে কী? অন্য কাগজে দিয়ে দিলেন নাকি?
অর্ণব দত্ত মাথা নেড়ে বললেন, তাই হয় নাকি? আপনার গল্প অন্যকে দিয়ে দেব? গল্পটা আমার নিজের দোষে মাঠে মারা গেছে।
রামলগন নড়েচড়ে বসলেন, আপনার কথার মানেটা বুঝলাম না।
কপালের শিরা দুটো এখনও দপদপ করছে, সে দুটো চেপে ধরে আস্তে আস্তে অর্ণব দত্ত গতকাল রাতের ঘটনা এবং তার আগে ডাক্তারের পরামর্শ সবই রামলগনকে বললেন। এরপর লেখার টেবিলের মদের বোতলটা দেখিয়ে তিনি বললেন, ওই আধা বোতলটা খেয়েছিলাম।
কথাটা শুনে রামলগন যেন একটু খুশিই হলেন। বললেন, মদ খেয়ে তো ঠিক কাজই করেছেন। মদ খেয়ে লিখলে গল্পে যোশ হয়।
যোশ জিনিসটা যে কী সেটা অর্ণব দত্ত জানেন না, এর আগে শব্দটা তিনি শোনেননি। তিনি প্রশ্ন করলেন, যোশ? যোশ আবার কী? আপনি কি যশের কথা বলছেন?
রামলগন বললেন, আরে তা নয়। যোশ হল লেখার আসল জিনিস। আপনার গল্পে হাসিঠাট্টা পাওয়া যায় কিন্তু যোশ থাকে না। এই দেখুন বনমালী মৈত্রের উপন্যাস যোশে ভর্তি, কলেজের ছেলেমেয়েরা হইহই করে পড়ে। বনমালীবাবুর লেখা নিয়ে চায়ের কাপে তুফান উঠে যায়। টিভিতে সিরিয়াল হয়।
হ্যাং ওভারের মাথা জোরে নাড়াতে গেলে কষ্ট হয়। তবুও মাথা নাড়িয়ে অর্ণববাবু প্রতিবাদ জানালেন, অসম্ভব কথা বলছেন মিঃ তেওয়ারি। আমি মরে গেলেও কখনও বনমালী মৈত্রের মতো লেখার কথা ভাবব না।
বনমালীবাবুর ওপর আপনার রাগ আছে আমি জানি, তেওয়ারি বললেন, কিন্তু যোশের কথা যদি বলেন, কাল একটা লেখা পেয়েছি মুম্বই থেকে, মুনিয়ার ঘরে রাত। কী যোশ তাতে পাতায় পাতায়, লাইনে লাইনে যোশ। পড়তে পড়তে মনে হয় মুনিয়ার সুখে আমি সুখী, এমন মধুর রাত যেন না ফুরোয়।
ভাল করে এসব কথা শুনছিলেন না অর্ণব দত্ত, অন্যমনস্ক ভাবে জিজ্ঞাসা করলেন, লেখা কার?
রামলগন বললেন, একদম নতুন লেখিকা। শ্রীমতী অমলিনা, মহিলা প্রথম লেখাতেই বাজার মাত করবেন।
শ্রীমতী অমলিনা নামটি শুনে অর্ণব একটু নড়েচড়ে বসলেন, প্রশ্ন করলেন, মুম্বই থেকে লেখা পাঠিয়েছেন?
তেওয়ারি বললেন, বুঝলেন দত্তদা, সব এক্সপেরিয়েন্সের ব্যাপার। আপনিও আপনার এক্সপেরিয়েন্সের কথা লিখুন। এখন মদ ধরেছেন, দেখবেন শোঁ শো করে যোশের লেখা কলম থেকে বেরবে।
যোশের নিকুচি করেছে। হ্যাং ওভারটা তখন চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে আধকপালেতে পরিণত হয়েছে। অর্ণব দত্ত খেঁকিয়ে উঠলেন, মদ খেয়ে কখনও গল্প লেখা যায়। কাল রাতে কাগজ, কলম, স্বাস্থ্য সব নষ্ট হয়েছে। বৃথা পণ্ডশ্রম করেছি।
এতক্ষণে তেওয়ারি আসল জায়গায় এসে গেছেন। অর্ণব দত্তের মতো জনপ্রিয় লেখক মদ খেয়ে বেসামাল হয়ে কী লিখেছেন, সেটা দেখা দরকার। তিনি কথা ঘুরিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কাল রাতের গল্পটা কী করলেন?
শুকনো মুখে অর্ণববাবু বললেন, ওয়েস্ট পেপার বাসকেটে ফেলে দিয়েছি।
টেবিলের পাশেই বাজে কাগজের ঝুড়ি। রামলগন একটু উঠে গিয়ে গল্পটা সেখান থেকে তুলে আনলেন। ওপরেই রয়েছে, খুঁজতে হল না। তারপর পাকা সম্পাদকের মতো গভীর অভিনিবেশ সহকারে পড়তে লাগলেন।
পড়তে পড়তে উত্তেজিত হয়ে পড়লেন রামলগন। কেয়াবাৎ, কেয়াবাৎ, সুপার-ডুপার এইসব বিশেষণ স্বগতোক্তি করতে লাগলেন, সেই সঙ্গে জোরে জোরে বলতে লাগলেন, কী যোশ, কী যোশ।
ওই অখাদ্য এলেবেলে গল্প পড়ে ঝুনো সাহিত্য ব্যবসায়ী রামলগন তেওয়ারি এমন বিহ্বল হয়ে যাবেন, সেটা কল্পনারও অতীত। অর্ণব দত্ত বিমূঢ় দৃষ্টিতে তেওয়ারির দিকে তাকিয়ে রইলেন।
তেওয়ারি বললেন, দত্তদা, আপনার এ গল্প বাংলা ভাষার সুরাযুগের পথিকৃৎ হয়ে থাকবে। কিন্তু আগে আমাকে বলুন, আপনার গল্পে দেখলাম শ্রীমতী অমলিনার কথা লিখেছেন। ওনাকে জানলেন কবে?
একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে অর্ণব বললেন, খুব ব্যক্তিগত ব্যাপার, ও প্রসঙ্গ বাদ দিন। কিন্তু আপনি বলুন তো এ গল্প চলবে কী করে? নায়কের নাম তিনবার বদলে গেল, তিন জায়গায় নায়কের বউয়ের নাম তিনরকম। পুরী এক্সপ্রেস শেয়ালদা থেকে ছাড়ছে। একটা কাহিনিতে এত গোলমাল থাকা উচিত?
এবার তেওয়ারির সম্পাদক-স্বরূপ দেখা গেল। পাঁচটি ভারতীয় ভাষায় সর্বাধিক প্রচারিত নবযুগ মাসিক পত্রের প্রধান সম্পাদক রামলগন অর্ণবকে বললেন, আপনার এই গল্প যেটা কাল মদ খেয়ে লিখেছেন, এরকম যোশের গল্প লেখা সোজা কথা নয়। শুধু দু-চারটে ঠেকা দিতে হবে।
গল্পে ঠেকা দিতে হবে? গল্পে আবার কী করে ঠেকা দেয়, ঠেকা কীভাবে দিতে হয়, অর্ণব দত্ত তার তিন দশকের সাহিত্যিক অভিজ্ঞতা নিয়ে চিন্তায় পড়লেন, সতত পরিবর্তনশীল চরিত্র নামগুলি এবং রেলপথের ধাঁধা এ দুয়ের সমাধান হবে কী করে?
রামলগনবাবু তুখোড় সম্পাদক, তুখোড়তর ব্যবসায়ী। তিনি অর্ণবকে বললেন, আপনি আপনার গল্পের প্রথমে যেখানে ভূমিকা থাকে সেখানে একটা ফুটনোট বা পাদটীকা দিয়ে দিন।
অর্ণব দত্ত বিড়ম্বিত বোধ করলেন, গল্পের প্রথমে ফুটনোট, পাদটীকা?