গাড়িতে ওঠার পরে কিশোর ড্রাইভারকে বলেছিল শরৎ বসু রোডে তার বাড়ি। ড্রাইভার যে এত মদ খাওয়ার পরেও কোনও দুর্ঘটনা না করে এতদূরে আসতে পেরেছে সেটা ভাগ্যের কথা। তবে শরৎ বসু রোডের ওই মাথায় পদ্মপুকুরের পাশে একটা দোতলা বাড়িতে থাকে কিশোর, সে জায়গাটা এখান থেকে খুব কাছে নয়।
সামনের সিটে ড্রাইভারকে দুবার ধাক্কা দিয়ে তোলার চেষ্টা করল কিশোর। লোকটা দুবার হু হু করে, তারপর সিটের উপর উপুড় হয়ে শুয়ে গাঢ় নিদ্রায় নিমগ্ন হল। চাঁদের আলোয় কিশোর দেখতে পেল ওর পায়ের কাছে রামের বোতলটা পড়ে রয়েছে, তাতে এক-তৃতীয়াংশ পানীয় এখনও বর্তমান। কিশোরের নিজের বোতলটাও পিছনের সিটে রয়েছে কিন্তু সেটা খালি, তাতে আর কিছু অবশিষ্ট নেই।
ড্রাইভারের পায়ের কাছ থেকে হাত বাড়িয়ে বোতলটা তুলে নিল কিশোর। ড্রাইভার বোধহয় কিছু টের পেয়েছিল, ওই আচ্ছন্ন অবস্থাতেই মৃদু বাধাদানের চেষ্টা করল। কিশোর তার হাত ছাড়িয়ে বোতলটা বগলে নিয়ে টালমাটাল চরণে বাড়ির দিকে রওনা হল।
এখান থেকে নাক-বরাবর মাইল দুয়েক রাস্তা যেতে হবে। এটুকু রাস্তা মাতালের পক্ষে কিছুই। নয়, বিশেষ করে হাতের বোতলে এখনও যখন একটু পানীয় আছে। একটাই ভয়, হঠাৎ পা জড়িয়ে পড়ে না যায়। কিন্তু গাড়িতে ঘুমিয়ে নেশাটা এখন একটু ধাতস্থ হয়েছে। সুতরাং বোতল থেকে অল্প অল্প পানীয় গলায় ঢালতে ঢালতে বাড়ির পথে ভালই এগোল কিশোর।
এক সময়ে কিশোরের খেয়াল হল যে তার হাতের বোতল শূন্য হয়ে গেছে এবং সে নিজের বাড়ির সামনে এসে গেছে।
কিশোরের কাছে বাড়ির সদর দরজার একটা ডুপ্লিকেট চাবি থাকে। এই মাতাল অবস্থাতেই সেটুকু খেয়াল আছে তার। পকেট হাতড়িয়ে চাবিটা বার করল কিশোর, ভাগ্যিস গাড়ির মধ্যে পড়ে যায়নি, শান্তিনিকেতনি ব্যাগটা তো গাড়িতেই রয়ে গেল।
কিশোরের মাথাটা ঝিমঝিম করছে। পরের বারের মদটা না খেলেই ভাল হত। তার হাত পা টলছে, কিছুতেই চাবি দিয়ে বাড়ির দরজাটা খুলতে পারছিল না কিশোর। বার বার চাবির মুখটা পিছলে পিছলে যাচ্ছিল।
হঠাৎ পিছন থেকে একটা পুলিশের কালো গাড়ি এসে দাঁড়াল। গাড়ির পিছনের দরজা দিয়ে নেমে এল লম্বাচওড়া হৃষ্টপুষ্ট গুম্ফমান এক হিন্দুস্থানি জমাদার। জমাদারজির গায়ে লংক্লথের ঢোলাহাতা পাঞ্জাবির সঙ্গে মালকোঁচা দিয়ে ধুতি পরা পায়ে কালো পামশু।
জমাদার সাহেব নেমেই প্রথমে কিশোরের হাত থেকে বোতলটা ছিনিয়ে নিলেন এবং সেটা শুন্য দেখে একটু রেগে সেটা দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন, তারপরে ঘাড়ের পেছন থেকে কিশোরের জামার কলারটা ধরে হুমকি দিলেন, এই মাতাল, এত রাতে হচ্ছেটা কী? চল, থানায় চল।
পুলিশ বুঝতে পেরে কিশোর একটু থমকিয়ে গেল, তারপর হেঁচকি তুলে বলল, জমাদারসাহেব, বাড়িতে ঢুকব, তাই দরজাটা চাবি দিয়ে খুলছি… বলে হাতের চাবিটা তুলে দেখাল।
জমাদারসাহেব অবাক হলেন, বাড়ি? দরজা? কেয়া বোলতা তুম?
কিশোর করজোড়ে বলল, হুজুর, এই আমার বাড়ির সদর দরজা আর দোতলায় ওই যে দেখছেন আলো জ্বলছে, ওটা আমার শোয়ার ঘর।
একটা খারাপ গালাগাল দিয়ে কিশোরের কলার ধরে শক্ত হাতের মুঠোয় একটা জোরে ঝকানি দিলেন জমাদার সাহেব।
ঝাঁকুনি খেয়ে কিশোরের মাথা থেকে কিছুটা অ্যালকোহল নেমে গেল। সে দেখতে পেল যে সে এতক্ষণ ধরে বাড়ির সামনের ল্যাম্পপোস্টটায় চাবি লাগানোর চেষ্টা করছিল এবং পোস্টের ওপরের বালবটাকে ভাবছিল তার দোতলার শোয়ার ঘরের আলো, যেটা জানলা দিয়ে রাস্তা থেকে দেখা যায়।
একটু সম্বিৎ ফিরে এসেছে কিশোরের। কিন্তু এখন জমাদারসাহেব তাকে ঘাড়ে ধরে পুলিশভ্যানের দিকে ঠেলা শুরু করেছে। সে কাকুতিমিনতি করতে লাগল, জমাদার সাহেব, ছেড়ে দিন। এই দেখুন, সত্যি এই সামনের দোতলা বাড়িটা আমার।
কিশোরের কথা শুনে জমাদারসাহেবের মনে হল, হয়তো লোকটা মিথ্যে কথা বলছে না। তা ছাড়া এত রাতে থানায় মাতাল নিয়ে যাওয়া সেও এক হাঙ্গামা। সুতরাং দেখা যাক সত্যিই এই সামনের বাড়িটা এই মাতালটার কিনা। তাহলে এটাকে ছেড়ে দিয়ে থানায় গিয়ে ঘুমনো যায়, রাতও অনেক হয়েছে।
জমাদারসাহেবের বজ্রমুষ্টি কিঞ্চিৎ শিথিল হতে কিশোর নিজের সদর দরজার দিকে এগোল। কর্তব্যপরায়ণ জমাদার সাহেব কিন্তু পিছু ছাড়লেন না।
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পিতলের যুগ্ম নেমপ্লেটের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করল কিশোর, তারপর নিজের বুকে হাত রেখে বলল, ওই যে প্রথম লাইনে লেখা দেখছেন মি. কে কে পাল, ওই কে কে পাল কিশোরকুমার পাল হলাম আমি। আর নীচের লাইনে মিসেস এস পাল মানে মিসেস শ্যামা পাল হলেন আমার পত্নী।
আত্মপরিচয় শেষ করে দরজায় চাবি লাগিয়ে ঘোরাল কিশোর, দরজাটা খুলে গেল। ভেতরে ঢুকে সিঁড়ির নীচের বাতিটা সুইচ টিপে জ্বালালো কিশোর। জমাদারসাহেব ইতস্তত করছিলেন, কিশোর তাঁকে অনুরোধ করল, আসুন, ভেতরে আসুন স্যার।
জমাদারসাহেব ভেতরে আসতে সামনের দেওয়ালে একটা বড় ফটো দেখিয়ে কিশোর বলল, এটা হল আমার শ্বশুরমশায়ের ছবি, মিস্টার পরেশচন্দ্র দাশ, আয়রন মার্চেন্ট, লোহাপট্টিতে নিজের গদি আছে।
আর সরেজমিন করার ইচ্ছা নেই জমাদারসাহেবের কিন্তু কিশোর তাকে জোরজার করে। দোতলায় তুলল। দোতলায় উঠে ছোট বারান্দা পেরিয়ে শোবার ঘর।