এদিকে যে নার্স নির্মলাকে ড্রেসিং করে বোয়াতে-মোছাতে গিয়েছিলেন, তিনি যত রক্ত মোছেন তারপর আর কিছুই পান না কোথাও, শুধু রক্ত আর রক্ত, দু-একটা কাঁচের টুকরো, কিন্তু কোথাও একটা কাটা নেই, একটু ছড়ে যাওয়া পর্যন্ত নেই।
বিব্রত নার্স ডাক্তারদের ডাকলেন। ডাক্তারেরা এসেও অবাক। তারা ভাবলেন, তা হলে বোধ হয় নাক বা মুখ দিয়ে এত রক্ত বেরিয়েছে, কিন্তু সে রক্ত কপালে, মাথায় চুলে লাগবে কী করে? কিছুক্ষণ বিমূঢ়তার পর একজন ডাক্তার নির্মলাকে জিজ্ঞাসা করলেন, এত রক্ত এল কোথা থেকে? নির্মলা বললেন, এ রক্ত আমার নয়, অন্য লোকের রক্ত। উত্তর শুনে ডাক্তারদ্বয় এবং নার্স স্তম্ভিত হয়ে নির্মলার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন, তাদের চোখেমুখে প্রচণ্ড সন্দেহের ছায়া। একটু পরে একটু সরে গিয়ে নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে কী আলোচনা করে একজন এসে কঠিন কণ্ঠে নির্মলাকে বললেন, আপনার কিছুই হয়নি। যান, বাড়ি চলে যান।
হাসপাতাল থেকে ধমক খেয়ে নির্মলা বেরিয়ে এলেন। বউবাজারে চলেছিলেন দিদির বাড়িতে। আর বউবাজারে গিয়ে দরকার নেই, সাতটা বেজে গেছে, রাত্রির শো-য় সিনেমার টিকিট কাটা আছে, গিয়েই তৈরি হতে হবে। বি টি রোডের ফ্ল্যাটে ফিরে চললেন নির্মলা।
বাসায় ফেরার পর নির্মলার স্বামী মহাদেব সব শুনে তো হই-চই লাগিয়ে দিলেন, তুমি যে রকম বোকা। নির্মলা যত বলেন, আমি কী করব? মহাদেব আরও ক্ষেপে যান কী সাংঘাতিক, এখনও তো কানে, ঘাড়ে রক্ত লেগে রয়েছে, কার না কার রক্ত, ছি ছি ছি।
নির্মলারও ঘেন্না করছিল, বাথরুমে গিয়ে ভাল করে সাবান মেখে স্নান করলেন। কিন্তু মহাদেব অত সহজে ছাড়বার লোক নন, কার কী ইনফেকশন আছে কে জানে, কার কীরকম রক্ত, হাসপাতালে রক্ত পরীক্ষা করালে না কেন? নির্মলা বলেন, অন্যের রক্ত আমি কী পরীক্ষা করাব? অবশেষে অনেক তর্ক-বিতর্কের পর স্থির হল পরিশুদ্ধ হওয়ার জন্যে নির্মলা সমস্ত মুখ, ঘাড়, পিঠ কোনও লোশন দিয়ে মুছে ফেলবে। কিন্তু ডেটল খুঁজতে গিয়ে দেখা গেল, শিশিতে একবিন্দু ডেটল। নেই। এদিকে সিনেমার সময় হয়ে এসেছে, দোকানে গিয়ে ডেটল কিনে আনতে গেলে দেরি হয়ে যাবে। এ ছাড়া বাসায় কোনও অ্যান্টিসেপটিক লোশন নেই। পাশের ফ্ল্যাটে খোঁজ করতে গেলেন। নির্মলা, তাদের মলমের ব্যবসা, নিশ্চয়ই কিছু পাওয়া যাবে। কিন্তু সেখানেও কিছু নেই, তবে তাদের কাছে বিশুদ্ধ অ্যালকোহল, যাকে র অ্যালকোহল বলে তা কয়েক বোতল আছে, তাই দিয়ে নাকি সব মলম তৈরি হয়। আধ শিশি তাই নিয়ে এল নির্মলা।
মহাদেব তো অ্যালকোহল দেখে উত্তেজিত, দাও অর্ধেক আমি খাই, অর্ধেক তুমি মাখো। শেষ পর্যন্ত সত্যি অর্ধেক জল মিশিয়ে মহাদেব খেলেন, বাকি অর্ধেক নির্জলা নির্মলা মাখলেন। প্রথমে। নির্জলা মাখতে তিনি রাজি হননি, কিন্তু মহাদেব জোর করলেন, জল-টল মিশিয়ো না, এইভাবে মাখো, সম্পূর্ণ শুদ্ধ হয়ে যাবে।
অ্যালকোহল মাখবার ও পান করার পর মহাদেব-নির্মলা দম্পতি বেরোলেন সিনেমা দেখতে। ওই বিশুদ্ধ তরল পদার্থ মাখবার পর থেকে কীরকম অস্বস্তি বোধ করছিলেন নির্মলা। সিনেমা হলে বসে নিউজ-রিল শেষ হয়ে আসল বই আরম্ভ হওয়ার আগেই নির্মলার মুখে-চোখে কীরকম একটা ব্যথা করতে লাগল। আলগোছে মুখের উপর হাত বোলাতে বুঝতে পারলেন ফোঁসকা উঠছে: ক্রমশ। ফোঁসকা উঠতে লাগল; ফোঁসকা আরও ফোঁসকা, আরও ফোঁসকা।
ইন্টারভ্যালের আলো জ্বলতেই চমকে উঠলেন মহাদেব। নির্মলার মুখমণ্ডল ফোঁসকায় ছেয়ে গেছে, যেগুলো সদ্য উঠেছে সেগুলো গোলাপি রঙের, পরের গুলি টকটকে লাল আর কতকগুলি এরই মধ্যে কালচে রং ধরেছে।
সিনেমা আর দেখা হল না। মহাদেব আঁতকে লাফিয়ে উঠলেন, সর্বনাশ, তোমার মুখের কী অবস্থা হয়েছে! প্যাসেজ দিয়ে দ্রুত বেরোতে বেরোতে লম্বা টানা আয়নায় নিজের চেহারা দেখে নির্মলা নিজেও অস্থির হয়ে উঠলেন, কী সাংঘাতিক!
হল থেকে বাইরে এসে মহাদেব ট্যাক্সি ডাকলেন, এই চলো মেডিক্যাল কলেজ। নির্মলা মেডিক্যাল কলেজের কথা শুনে কী একটা প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু ব্যথা-যন্ত্রণায় তখন তিনি অস্থির।
মেডিক্যাল কলেজের ইমার্জেন্সির সামনে আবার এসে ট্যাক্সি দাঁড়াল। আবার সেই একই ওয়ার্ড, ডাক্তার দুজন এবং নার্স এখনও অপরিবর্তিত। নির্মলাকে দেখে এবার তারা চমকে উঠলেন, সন্ধ্যায় যাঁর রক্তাক্ত মুখ দেখে তারা বিচলিত হয়েছিলেন, এখন তার মুখে নানা বর্ণের, নানা আকারের ফোঁসকা। এবার কিন্তু তারা মুহূর্তের মধ্যে মনঃস্থির করে ফেলেছেন, একজন এগিয়ে এসে নির্মলাকে গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনিই না সন্ধ্যাবেলায় রক্ত মেখে এসেছিলেন? নির্মলা ক্ষীণ কণ্ঠে কী উত্তর দিলেন বোঝা গেল না। এবার ফোঁসকা লাগিয়ে এসেছেন? পরের প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়। নির্মলার জবাবের জোর নেই, মহাদেব নির্বাক। অবশেষে পিছন থেকে নার্সটি কাংস্যকণ্ঠে বললেন, এসব চালাকি এখানে চলবে না।
নির্মলা আর মহাদেব গুটি গুটি বেরিয়ে এলেন হাসপাতাল থেকে। ব্যথায় যন্ত্রণায় নির্মলা তখন অস্থির, তারই মধ্যে দেখতে পেলেন সেই গ্রাম্য ভদ্রলোকটি বারান্দায় দেয়ালে ঠেস দিয়ে পড়ে রয়েছে, তার হাতের তালুতে চাপ চাপ রক্ত জমাট ধরে তখন কালো হয়ে গিয়েছে, তবে নতুন করে আর রক্ত পড়ছে না।
একটি গল্পের নবজন্ম
অর্থ বড় না প্রেম (মতান্তরে কাম) বড় এই রকম জটিল বিষয়ে আমার একটি গল্প ছিল সম্পাদকের দপ্তরে।