আরশোলার যখন এবম্বিধ প্রকৃতির পরিচয় মানুষ মাত্রেই জ্ঞাত আছেন, ইহাকে অনায়াসেই মানুষের কাজে নিয়োগ করা যাইতে পারে। রজক, ক্ষৌরকার ইত্যাদি বাবদ প্রত্যেক গৃহস্থেরই এদেশে যথেষ্ট ব্যয় হয়। কিন্তু বিলাত ইত্যাদি দেশে কাপড় কাচিবার যন্ত্র, এমনকী দাড়ি কামাইবার বৈদ্যুতিক যন্ত্র আবিষ্কার হইয়াছে।
আমাদের দরিদ্র দেশের পক্ষে এইগুলি খুবই ব্যয়সাধ্য। সকলের ব্যবহার করিবার আর্থিক যোগ্যতা নাই।
জীব-জন্তুকে শিক্ষিত করিয়া নানাবিধ কার্য সম্পাদন করা যায়। বানর, হাতি, ঘোড়া, কুকুর, এমনকী পাখিও নানা কাজ করিতে পারে। আরশোলাকেও উপযুক্ত ট্রেনিং দিতে পারিলে তাহার দ্বারা কোনও কার্য অসম্ভব নহে। যথাসময়ে মাথায় ছাড়িয়া দিলে উপযুক্ত পরিমাণ চুল খাইয়া লইলেই চুল কাটার কাজ হইয়া যাইবে। প্রথম দিকে শিশুদের মাথায় ছাড়িয়া এবং গায়ে সুতা বাঁধিয়া মাথায় ঠিকমতো চালাইলে পরে ভাল কাজ পাওয়া সম্ভব।
এক-একটি আরশোলা গড়ে নয়মাস বাঁচে, অর্থাৎ একটি সামান্য আরশোলা নয়বার চুল কাটা এবং দুইশত সত্তর বার (যাঁহারা দৈনিক দাড়ি কামান) দাড়ি কামানোর খরচ বাঁচাইতে পারিবে।…
করতোয়া যখন প্রবন্ধটি পাঠ করিতেছিল, প্রত্যেক অংশ শুনিতে শুনিতে আচার্য মহাশয়ের মুখভাব উজ্জ্বল হইয়া উঠিতেছিল। আমার প্রায় কিছুই বলিবার ছিল না। শুধু জানিতে চাহিলাম, এইরূপ ট্রেনিংপ্রাপ্ত কোনও আরশোলা…
আচার্য মহাশয় আমাকে বাক্য সম্পূর্ণ করিতে দিলেন না। একটি কাঁচের বাক্স বারান্দা হইতে লইয়া আসিলেন। তাহাতে দশ-পনেরোটি আরশোলা এবং একটি প্লেটে অল্প একটু দুধ রহিয়াছে। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, প্লেটে কী, দুধ?
উপরের ছাদে আরেকটি খাঁচা আনিবার জন্য আচার্য মহাশয় উঠিয়া গিয়াছিলেন, করতোয়া ছিল, সেই জবাব দিল, হ্যা দুধ খেলে ওদের বুদ্ধি হবে। আচার্য মহাশয় ঘরে ঢুকিতে ঢুকিতে করতোয়ার কথা ধরিলেন, দুধ হল স্নেহ পদার্থ, এতে বুদ্ধি হবে। তবে তেলই ওদের খাদ্য, তবে সেটা দিলে মাথার চুলের তেল আর ওরা খেতে চাইবে না।
সন্দেহ নাই, অকাট্য যুক্তি। কিন্তু স্থানীয় পাক্ষিক নিদারুণ বার্তার মুর্থ সম্পাদক নিবারণ সামন্ত আচার্য মহাশয়ের এই গবেষণাকে পাগলামি বলিয়া হাসি-তামাসা করিয়াছে। আজ সকালেই নিদারুণ বার্তার বর্তমান সংখ্যা আচার্য মহাশয়ের হস্তগত হইয়াছে। পাঠ করিয়াই ছাদে উঠিয়া নিবারণ সামন্তের বাড়ির দিকে মুখ করিয়া তিনবার বন্দুকের ফাঁকা আওয়াজ করিয়াছেন।
আরশোলার বুদ্ধি এবং নিবারণ সামন্তের বুদ্ধির অভাব বিষয়ে আচার্য মহাশয়ের সঙ্গে সেইদিন সারা দুপুর আলোচনা করিয়া বৈকালে করতোয়ার সঙ্গে গঙ্গাতীরে ভ্রমণ করিয়া সন্ধ্যাবেলা ফিরিয়া আসিলাম। কথা দিয়া আসিলাম, সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে আবার আসিব। আরশোলা দিয়া চুল কাটাইয়া যাইব। ততদিনে আরশোলাগুলি উপযুক্ত শিক্ষিত হইবে এইরূপ আশা করা গেল।
কিন্তু দুই সপ্তাহ লাগিল না। আচার্য মহাশয় গুরুতর অসুস্থ, করতোয়ার নামে প্রেরিত এক তার পাইয়া সাতদিনের মধ্যে আরেকবার যাইতে হইল।
আচার্য মহাশয়ের বিরূপ সমালোচনা করিবার পর নিবারণ সামন্ত একটু মর্মপীড়ায় ভুগিতেছিলেন। তাহা ছাড়া নিদারুণ বার্তার নয়জন ক্রেতার মধ্যে আচার্য মহাশয় একজন। তাই তিনি একদিন আচার্য মহাশয়ের সঙ্গে একটি আপোস-রফায় আসিবেন ইচ্ছায় একদিন তাঁহার বাড়িতে আসেন। সামন্ত মহাশয় বুদ্ধিমান ব্যক্তির ন্যায় এইবার আরশোলা বিষয়ে যথেষ্ট উৎসাহ প্রদর্শন করিতে থাকেন। সামন্তকে দেখিয়া আচার্য মহাশয় প্রথমে উত্তেজিত হইলেও পরে তাহার আচরণের পরিবর্তন দেখিয়া তাঁহাকে যথেষ্ট সৌজন্য প্রদর্শন করেন। আরশোলাগুলিকে কীভাবে শিক্ষা দেওয়া হইবে তাহা খাঁচা খুলিয়া দেখাইতে যান। কিন্তু ইতিমধ্যে দুধ-ক্ষীর ইত্যাদি স্নেহপদার্থ খাইয়া আরশোলাগুলি যে ভীমরুলের প্রকৃতি ধারণ করিয়াছে, ইহা সামন্ত বা আচার্য মহাশয় কেহই অনুমান করিতে পারেন নাই। খাঁচা খোলামাত্র পনেরোটি দুর্দান্ত আরশোলা তাহাদের দুইজনের উপর ঝাপাইয়া পড়ে। করতোয়া বঁটা লইয়া ছুটিয়া না আসিলে সেইদিনই বোধ হয় এই দুইজনকেই আরশোলার দংশনে প্রাণত্যাগ করিতে হইত।
বর্তমানে সামন্ত ও আচার্য মহাশয় দুইজনেই স্থানীয় হাসপাতালে পাশাপাশি শয্যায় চিকিৎসিত হইতেছেন। দুজনেরই মুখ এত ফুলিয়া গিয়াছে যে প্রথম দর্শনে কে নিবারণ সামন্ত আর কে রুদ্রনারায়ণ আচার্য ঠাহর করা কঠিন।
করতোয়াকেও একটি আরশোলা দংশন করিয়াছিল, তাহার বিশেষ কিছু হয় নাই, শুধু গণ্ডদেশ কিঞ্চিৎ রক্তিম ও স্ফীত হইয়াছে।
এক প্রধানের গল্প
শ্রীযুক্ত বটেশ্বর প্রধানের উপাধিই শুধু প্রধান নয়, তিনি গ্রাম প্রধানও বটেন। খলিলপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের তিনিই প্রধান।
এত জায়গা থাকতে কেন খলিলপুর নামক একটি সাধারণ গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধানকে নিয়ে এই গল্প লিখছি। সে প্রশ্ন যেকোনও পাঠক করতে পারেন।
আশা করি এই গল্পটি পাঠ করার পরে তাঁদের কারও মনে আর এরকম কোনও প্রশ্ন থাকবে। তার কারণ বটেশ্বরবাবু কোনও সামান্য ব্যক্তি নন, তাঁর মতো স্থিতধী, ঠান্ডা মাথার বুঝমান লোক খুব বিরল। কোনও রকম ছল-চাতুরী বা চালাকি করে বটেশ্বরবাবু গ্রাম প্রধান হননি। গ্রামবাসী প্রায় প্রত্যেকেই তাকে প্রধান বলে মেনে নিয়েছেন, তার বুদ্ধি ও বিবেচনার কথা স্মরণে রেখে।