ছোট গল্পের পরিসরে বিস্তারিত বলা যাবে না। আমাদের এই আখ্যানের কুশীলবেরা বাংলা খান। বাংলা মানে দিশি মদ, এ যাত্রা দিশি মদের কথাই বলছি।
দিশি মদ, বাংলা মদ নামেই সমধিক প্রচলিত। বাংলাদেশেও শুনেছি, পশ্চিমবঙ্গেও তাই সরকারি দিশি মদের পরিচয় বাংলা বলে। অবশ্য এর বাইরে বেআইনি, বেসরকারি চোলাই দিশি মদ আছে, যাকে গ্রাহকেরা ভালবেসে চু বলে।
সরকারি দিশি মদকে যে বাংলা মদ বলা হয় এ বিষয়ে আমার মনে একটা খটকা আছে। দিশি মদ এই বাংলাতেই বাংলা মদ, বিহারে কিন্তু বিহার মদ নয়। মাদ্রাজে মাদ্রাজ মদ বা তামিল মদ নয়।
আরেকটা কথা উল্লেখ করে রাখি, আমাদের দেশে যেসব বিলিতি মদ তৈরি হয় সরকারি পরিভাষায় সেও দিশি মদ, কানট্রি মেড ফরেন লিকার, সংক্ষেপে (সি এম এফ এল) আর বাংলা মদ হল কানট্রি লিকার, দিশি মদ।
বাংলা মদের দোকানের আরেকটা বিশেষত্ব হল এসব দোকানের কোনও নাম থাকে না। সাইনবোর্ড পর্যন্ত থাকে না। কোথাও কদাচিৎ সাইনবোর্ড থাকলে তাতে দোকানের কোনও নাম দেয়া থাকে না। সেখানে লেখা থাকে, মদের দোকান, ভেন্ডার রামচন্দ্র সাউ কিংবা শ্যামনাথ সাধুখাঁ।
আরশোলা এবং নিদারুণ বার্তা
রুদ্রনারায়ণ আচার্য মহাশয় বিভাগপূর্ব বঙ্গদেশের এমন একটি জেলায় বাস করিতেন যেখানে আরশোলাকে তেলাচোরা বলা হইয়া থাকে। আরশোলাই আমাদের বর্তমান গল্পের বিষয়বস্তু। তাই পূর্বাহ্নে কিঞ্চিৎ ভূমিকা করিয়া লইতে হইতেছে।
প্রথমে আচার্য মহাশয়ের পরিচয় প্রদান আবশ্যক। দেশে আচার্য মহাশয়ের বিরাট নারিকেল এবং সুপারি বাগান ছিল। নারিকেল এবং সুপারি বাগানের সুবিধা এই যে, এই প্রকার ফসল বৎসর বৎসর চাষ করিতে হয় না। কোনও পরিশ্রম নাই, লবণাক্ত মাটির আর্দসৌজন্যে অপর্যাপ্ত ফলন হয় এবং যথাকালে শুকাইয়া মাটিতে পড়ে। কোনও এক পরিশ্রমী পূর্বপুরুষের কল্যাণে বৎসর বৎসর পায়ের উপর পা তুলিয়া বংশধরদের চলিয়া যায়। যাহা কিছু পরিশ্রম বা অর্থব্যয় এই ফসলগুলি পাড়িয়া নামাইবার।
আচার্য মহাশয় অতিশয় বুদ্ধিমান ব্যক্তি ছিলেন। এইনামাইবার জন্যও তিনি কোনও রূপ পরিশ্রম বা তোক নিয়োগ করিতেন না। যতদিন মাধ্যাকর্ষণ শক্তি কার্যকরী আছে, শুকাইয়া বুনা হইলে, নারিকেল-সুপারি আপন আগ্রহেই ভূমিতলে খসিয়া পড়িবে, তাহার জন্য অপব্যয় করা একান্তই নিরর্থক।
এই সময়ে একবার তাঁহাকে আয়কর কমিশনের সঙ্গে দেখা করিতে হয়। আবেদন ছিল, এবার আয় ভাল হয় নাই, কিছু আয়কর পরবর্তী বৎসরে প্রদানের অনুমতি দেওয়া হউক। আয়কর সাহেব দেখিলেন, লোকটি আয়কর কমাইতে বলিতেছে না, শুধু সময় চাহিতেছে, কী মনে হইল, প্রশ্ন করিলেন, তোমার ফসল কম হলে আয়কর কম হবে, তুমি সময় চাও কেন, আয়কর কমাবার জন্য প্রার্থনা করো।
আচার্য মহাশয় ঘাড় চুলকাইয়া বলিলেন, ফসল ঠিক কম হয়েছে তা নয়, তবে এবার হাওয়া বড় কম।
সাহেব অবাক, হাওয়া কম!
আজ্ঞে হ্যাঁ, আচার্য মহাশয় জানাইলেন, এই হাওয়া লেগে শুকনো নারকেল-সুপারি মাটিতে পড়ে, এবার সেটা একটু কম পড়ছে।
ইহার পরে কী হইয়াছিল তাহা এই কাহিনির বিষয় নহে, তবে এই একটি প্রাক্তন ঘটনার উল্লেখ এইজন্য করিলাম যে, ইহাতে শ্রীযুক্ত রুদ্রনারায়ণ আচার্যের সম্পর্কে কিছু ধারণা করা সম্ভব হইতে পারে।
দেশ বিভাগের পরে আচার্য মহাশয় প্রথমেই কলিকাতায় চলিয়া আসেন। এই সময়েই টালিগঞ্জ থানার অফিস ঘরে তাহার সঙ্গে আমার আলাপ হয়।
আমরা ছাদে কাপড় মেলিয়া দিলে বিকালে যখন শুকাইয়া যাইত তখন আমাদের পরবর্তী প্রতিবেশী গোপনে সেগুলি একটি হোসপাইপ দিয়া ভিজাইয়া দিতেন। ইহাতে বিশেষ অসুবিধার সৃষ্টি হইত। এবং প্রথম প্রথম সবই সহ্য করিতাম, বস্তুত বুঝিতেই পারিতাম না কেন আমাদের বস্ত্রাদি সারাদিনের রৌদ্রে শুকাইত না। অবশেষে একদিন আমার কনিষ্ঠ ভাগিনেয় মাতুলালয়ে বেড়াইতে আসিয়া নিকট প্রতিবেশীর এরূপ গর্হিত কার্য আবিষ্কার করিয়া ফেলে। আমরা উপায়ান্তর না দেখিয়া প্রতিদিন রাত্রে পাঁচফোড়নের তরকারি খাইতে লাগিলাম। সায়াহ্নবেলায় যখন প্রতিবেশীদের বাড়িতে সংগীতশিক্ষক আসিতেন, সেই সময়ে তিনি যে ঘরে বসিয়া সংগীত শিক্ষাদান করিতেন সেইমুখী আমাদের বারান্দায় যথাসমারোহে পাঁচফোড়নের ব্যঞ্জন প্রস্তুত করা হইত। ব্যঞ্জনের ঋজে ছাত্র-ছাত্রী এবং শিক্ষকদের নাসারন্ধ্রে এবং কণ্ঠদেশে যে আকুতি উপস্থিত হইত তাহাতে প্রাণ ওষ্ঠাগত হইলেও সংগীত ওষ্ঠাগত হইত না। কিন্তু ইহাতেও কিছু হইল না। একদিন আমাদের অসাবধানতার সুযোগে শীতের অপরাহ্নে তাহারা আমাদের লেপগুলি ভিজাইয়া দিল।
বাধ্য হইয়া থানায় ডায়েরি করিতে আসিয়াছিলাম, দেখিলাম এক প্রৌঢ় ব্যক্তি প্রবল আবেগে ফুসিতেছেন। তাহার সামনে মোটা ধুতি ও নীল কোট পরিধানে এক ব্যক্তিকে পুলিশ ধরিয়া রাখিয়াছে। দ্বিতীয় ব্যক্তিটির এক হাতে বর্শা এবং অন্য হাতে একটি প্রজ্বলিত পেট্রম্যাক্স। কিছুক্ষণ পরে বুঝিলাম এই দ্বিতীয় ব্যক্তিটি প্রথম ব্যক্তির সঙ্গী বা রক্ষী। প্রথম ব্যক্তি অর্থাৎ আচার্য মহাশয় কিছুতেই সন্ধ্যাবেলায় রাস্তায় পেট্রম্যাক্স এবং আলোবাহক একজনকে অগ্রবর্তী না রাখিয়া বাহির হইতে পারেন না, ইহা তাহার বহুকালের অভ্যাস। তদুপরি ইহা দ্বারা, আচার্য মহাশয়ের মতে, কোনওরকম আইনভঙ্গ হয় নাই। বর্শা অস্ত্র আইনে পড়ে না। বর্শার ফলা মাত্র ছয় ইঞ্চি ইত্যাদি ইত্যাদি বহু যুক্তি তিনি প্রবল রোষে প্রদান করিতে লাগিলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে তৃতীয় ব্যক্তিরূপে আমাকে সাক্ষী মানিতে লাগিলেন।