এর মধ্যে পাটনায়েক কাজে যোগদান করেছেন এবং যথারীতি আবার তাঁর ভাগে পড়েছে আবহাওয়ার বুলেটিন। সদ্যলব্ধ জ্ঞানে অকুতোভয় এবং দ্বিধাহীন পাটনায়েক হাওয়া অফিসের বুলেটিন আর ছুঁয়ে দেখেন না। তাঁর ঘোষণার ঠিক পনেরো মিনিট আগে কলকাতা বেতারকেন্দ্রের ঘোষক বাংলায় যা বলেন তাই হুবহু টুকে নিয়ে ওড়িয়ায় তিনি পুনঃপ্রচার করেন।
ব্যাপারটা ধরা পড়ল দিন দশেকের মধ্যে। হাওয়া অফিসের অধিকর্তা আর আকাশবাণীর অধিকর্তা যুগপৎভাবে কয়েকটি অভিনন্দন পেয়ে বিস্মিত, হতবাক হয়ে গেলেন। এমন অভূতপূর্ব সঠিক পূর্বাভাস কটক বেতারকেন্দ্রে তো দূরের কথা পৃথিবীর কোনও বেতারকেন্দ্রে প্রচারিত হয় কিনা এ বিষয়ে অনেকেই অভিমত দিলেন।
দুই অধিকর্তা হতভম্ব। বৃষ্টি বললে বৃষ্টি, ঝড় বললে ঝড়, রোদ বললে রোদ এমন তো হওয়ার কথা নয়। সবই যদি এমন অবিশ্বাস্যভাবে মিলে যায়, লোকে যদি সরকারি ঘোষণা বিশ্বাস করতে আরম্ভ করে তা হলে তো সমূহ বিপদ।
সামান্য খোঁজ হতেই পাটনায়েক ধরা পড়ে গেলেন এবং সাসপেন্ড হয়ে গেলেন।
এখন আর তার জন্যে পাটনায়েকের দুঃখ নেই, কারণ তিনি জ্ঞান ও গবেষণার জন্যে শাস্তি পেয়েছেন, সক্রেটিস, গ্যালিলও থেকে পরশুদিনের ড. খোরানা পর্যন্ত সকলের কথা মনে করে পাটনায়েক সান্ত্বনা দিলেন নিজেকে।
এদিকে কিন্তু তিনি মোটেই থেমে থাকলেন না। তার চার্ট বইটি সাইক্লোস্টাইল করে ছাপিয়ে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার প্রতিটি মন্ত্রীকে, প্রতিটি বিরোধী দলের নেতাকে এমনকী লন্ডন, নিউইয়র্ক, মস্কো পৃথিবীর সব রাজধানীতে এবং ইউনেসকোতে এক কপি করে পাঠিয়ে দিলেন।
মাস তিনেক পরে ইউনেসকো ভারত সরকারের কাছে এ বিষয়ে একটি রিপোর্ট প্রার্থনা করলেন।
তখন খোঁজ পড়ল নিত্যানন্দ পাটনায়কের। কটক বেতার কেন্দ্রের অধিকর্তা ভাবলেন কীসে আবার কী হয়ে যায়। যেন কিছুই জানেন না এই ভাবে নিত্যানন্দবাবুকে ডেকে বললেন, কী মশায়, কাজে আসছেন না কেন আজকাল? তারপর নিত্যানন্দবাবু উত্তর দেওয়ার আগেই বললেন যে, আপনি একবার দিল্লি থেকে ঘুরে আসুন, আপনারা হলেন কৃতবিদ্য লোক।
অর্থাৎ নিত্যানন্দবাবুর সাসপেনশন রদ হয়ে গেল, অনেকগুলো টাকা বকেয়া মাইনে একবারে হাতে পেলেন এবং তদুপরি দিল্লি যাওয়া এবং থাকার খরচ।
এর পরের ঘটনা অতি সংক্ষিপ্ত করে বলা যেতে পারে, কারণ যাঁরা খবরের কাগজ পড়েন তারা। সবাই মোটামুটি বিষয়টি জানেন। নয়াদিল্লিতে একটি সর্বভারতীয় আবহাওয়া পূর্বাভাস তদন্ত ও অনুসন্ধান কমিটি গঠিত হয়েছে। তিনজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, তিনজন বৈজ্ঞানিক, একজন আই সি এস সেক্রেটারি এবং শ্রীযুক্ত নিত্যানন্দ পাটনায়েককে এই গুরুত্বপূর্ণ কমিটির সদস্য মনোনয়ন করা। হয়েছে।
কমিটি এখন পুরাদমে তাঁদের গবেষণা তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছেন। আকাশবাণীর সমস্ত কেন্দ্রের ঘোষকদের এই তথ্যানুসন্ধান কমিটির সামনে সাক্ষী ডাকা হয়েছে। হাওয়া অফিসের প্রধান কর্তারাও তাদের বিস্তারিত রিপোর্ট ও মতামত পেশ করেছেন।
মোট কথা, আবহাওয়া পূর্বাভাস তদন্ত ও অনুসন্ধান কমিটি পূর্ণোদ্যমে তাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। সমস্ত বড় বড় খবরের কাগজে এই কমিটি গঠন ও তার কার্যাবলি বিষয়ে একাধিক গুরুগম্ভীর সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়েছে।
এদিকে কটক মিউনিসিপ্যালিটি শহরতলির একটি মোটামুটি পরিচিত রাস্তার নাম পালটে নিত্যানন্দ পাটনায়েক স্ট্রিট নামকরণ করেছেন। আগামী বছর নিত্যানন্দবাবু অন্তত পদ্মভূষণ উপাধি পাবেন বলে অনেকেই অনুমান করেছেন। কেউ কেউ বলছেন নিত্যানন্দবাবুর নোবেল বিজ্ঞান পুরস্কার পাওয়াও উচিত। তবে সেটা পদার্থ না রসায়ন না অন্য কোনও শাখায় হবে সে বিষয়ে স্যার সি.ভি. রামনের কাছে খোঁজখবর নেয়ার জন্যে একটি ছোট কমিটি গঠিত হয়েছে কটক শহরে।
তবে কমিটির চূড়ান্ত রিপোর্ট এখনও প্রকাশিত হয়নি এবং সেই রিপোর্টের জন্যে দেশবাসী অধীর প্রতীক্ষা করছে।
.
শেষ সংবাদ
ভারত কা রাজপত্রে ঘোষিত একটি প্রেসনোটে এই মাত্র জানা গেল আবহাওয়ার পূর্বাভাস তদন্ত ও তথ্যানুসন্ধান কমিটির রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। তদন্ত কমিটি আশা করছেন এই রিপোর্টটি কার্যকরী করা হলে ভারতবর্ষে কোথাও আর আবহাওয়ার পূর্বাভাসে কোনও ভুলত্রুটি থাকবে না। সব অক্ষরে অক্ষরে মিলে যাবে।
এখন থেকে কটকের হাওয়া অফিসের বিজ্ঞপ্তি প্রচারিত হবে আকাশবাণী কলকাতায়, পাটনার বিজ্ঞপ্তি মাদ্রাজে, মাদ্রাজের বিজ্ঞপ্তি শিলং-এ এবং কলকাতার বিজ্ঞপ্তি কটকে। আকাশবাণীর সমস্ত কেন্দ্র এবং হাওয়া অফিসগুলির নাম তালিকা করে সাজিয়ে দিয়েছেন কমিটি, কোন কেন্দ্র থেকে কোন অফিসের বিজ্ঞপ্তি প্রচারিত হবে।
এর পর থেকে আশা করা যাচ্ছে কেউ আর আকাশবাণীর আবহাওয়া ঘোষণা নিয়ে হাসাহাসি করবে না, সবাই স্পষ্ট মিলিয়ে দেখতে পাবে, বৃষ্টি বললে বৃষ্টি হচ্ছে, রোদ বললে সঙ্গে সঙ্গে ঝকঝকে রোদ উঠছে, হোক না শ্রাবণ মাস।
আরম্ভ
এ গল্প উত্তম বা প্রথম পুরুষে আমি লিখব না। এর মধ্যে আমি কোথাও নেই। আমি এই কাহিনির তথাকথিত কোনও চরিত্র নই। কিন্তু গল্পলেখক হিসেবে কিঞ্চিৎ ভূমিকা করার প্রয়োজন আছে।
নির্মেদ পাঠক এবং নির্মেদিনী পাঠিকাদের কাহিনির সুবিধার্থে, দুয়েকটি মোটা তথ্য নিবেদন করি। মাতাল নিয়ে গল্প, তাই মদের ব্যাপারটা অল্প বলে নিচ্ছি। কেউ যেন ভাববেন না, প্রচুর মদ্যাসক্তির জন্যে এসব জিনিস আমি ধরে ধরে জেনেছি। তা নয়, প্রথম যৌবনে অধুনালুপ্ত ঐতিহাসিক রাজস্ব পর্ষদের বিলীয়মান আবগারি শাখায় কয়েক বছর কাজ করে কিঞ্চিৎ জেনেছিলাম।