দুঃখের বিষয়, এ ধরনের কোনও ঘোষণা আকাশবাণী একদিনের বেশি বরদাস্ত করবে না। শুধু একদিন মানে ওই প্রথম দিন, তার পরদিনই কানে ধরে আকাশবাণী থেকে বার করে দেবে, না হয় পাগলা গারদে পাঠিয়ে দেবে। এই দুর্দিনে নিজের কাজটিকে যতই উপহাসযোগ্য মনে হোক, নিত্যানন্দ পাটনায়েক কিছুতেই কাজ হারাতে রাজি নন।
নিত্যানন্দবাবুর মনের যখন এই অবস্থা, যখন নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও নেহাত প্রাণের দায়ে তাকে চাকরি করে যেতে হচ্ছে অর্থাৎ আবহাওয়ার অসম্ভব বুলেটিন পাঠ করে যেতে হচ্ছে সেই সময় একদিন সকালে সাড়ে সাতটার একটু আগে দৈববাণী শুনতে পেলেন।
আগেই বলেছি যে কলকাতা বেতারকেন্দ্রের প্রোগ্রামগুলির উপরে স্বাভাবিক অনুরাগ এবং কৌতূহলবশত তিনি যথাসম্ভব কান পেতে রাখতেন। কলকাতা বেতারকেন্দ্রেও কটকের মতোই আবহাওয়ার বুলেটিন প্রচারের আয়োজন আছে এবং তার জন্যেও একজন সংশয়াচ্ছন্ন, দ্বিধান্বিত ঘোষক আছেন।
তবে কলকাতা কেন্দ্রের আবহাওয়া ঘোষণা কটক কেন্দ্রের কয়েক মিনিট আগে হয়ে যায়। একদিন বুলেটিন পাঠ করার জন্য স্টুডিওতে প্রবেশ করার আগে নিত্যানন্দবাবু অভ্যাসমতো নিজের অনুবাদে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিলেন। সেদিন সকালবেলা বেশ মেঘলা, মাঝে মধ্যে জোর ঝাপটা বৃষ্টি হচ্ছে সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া।
বাইরের যখন এইরকম প্রাকৃতিক অবস্থা তখন যথারীতি নিত্যানন্দবাবুকে পাঠ করতে হবে, আজ সকালের দিকে আকাশ পরিষ্কার এবং সুন্দর আবহাওয়া থাকবে..ইত্যাদি, ইত্যাদি।
একবার নিজের অনুবাদ করা ঘোষণাপত্রটির দিকে তাকাচ্ছেন, আরেকবার জানলা দিয়ে বাইরে যেখানে আকাশবাণীর দেয়াল ঘেঁষে বুড়ো নিমগাছটার ডালে টপটপ করে জলের ফোঁটা পড়ছে আর শোঁ শোঁ হাওয়ার ঝাপটা লাগছে সেইদিকে অসহায়ভাবে তাকাচ্ছেন পাটনায়েক, এমন সময় তার কানে এল দৈববাণী। তারই প্রিয় বাংলা ভাষায় কলকাতা বেতারকেন্দ্রের ঘোষক বলছেন, প্রবল ঝড় ও বৃষ্টি হবে, এমনকী শিলাবৃষ্টি, সাইক্লোন হতে পারে।
কলকাতার ঘোষণা সম্পূর্ণ মিলে যাচ্ছে কটকের প্রাকৃতিক অবস্থার সঙ্গে কিন্তু নিত্যানন্দবাবুকে কটকের আবহাওয়া দপ্তরের বিজ্ঞপ্তিটিই পাঠ করতে হবে মিলুক বা না মিলুক।
সেইদিন বিজ্ঞপ্তিটি পাঠ করার পরেই ভীষণ শিলাবৃষ্টি হল কটকে। রেডিও স্টেশনের গেটে খোয়াবাঁধানো রাস্তা বরফকুচিতে ছেয়ে গেল তার পর এল সাইক্লোন। সেই সাইক্লোনে শুধু কটক শহরের কয়েকটি টিনের চালা এবং ছোট-বড় গাছই যে উলটে গেল তাই নয় শ্রীযুক্ত নিত্যানন্দ পাটনায়েকের মনের মধ্যেও একটা বিরাট আলোড়ন তৈরি হল। তিনি একনাগাড়ে সাত দিন ছুটির দরখাস্ত করে বাসায় গিয়ে শুয়ে পড়লেন।
বাসায় শুয়ে শুয়ে চারবেলায় চারবার করে কলকাতা আর কটকের আবহাওয়ার পূর্বাভাস শুনতে লাগলেন এবং বাইরের প্রাকৃতিক অবস্থার সঙ্গে মেলাতে লাগলেন। যতই মেলাতে লাগলেন তত চমৎকৃত হলেন পাটনায়েক। কলকাতার আবহাওয়া দপ্তর যাই বলে সব অক্ষরে অক্ষরে মিলে যায় কটকের অবস্থার সঙ্গে কিন্তু উড়িষ্যা হাওয়া অফিসের একটি ভবিষ্যৎ-বার্তাও মিলতে চায় না। মনে হয় কে যেন ইচ্ছে করে রসিকতা করছে।
বিছানায় শুয়ে থাকার জন্যেই হোক বা অন্য যেকোনও কারণেই হোক এই সাতদিনে নিত্যানন্দ পাটনায়েকের বুদ্ধি খুবই খুলে গেল। তিনি কলকাতায় তাঁর এক পুরনো কলেজি বন্ধুকে চিঠি লিখলেন–প্রত্যেকদিন সকাল, দুপুর, বিকেল এবং রাত্রিতে কেমন আবহাওয়া থাকে তার বিবরণ যেন অবশ্যই তাকে পরের দিনের সকালের ডাকে পাঠানো হয়, সঙ্গে কয়েকটি ঠিকানা লেখা রিপ্লাই। কার্ড পাঠিয়ে দিলেন। পুরনো বন্ধুটি নিত্যানন্দকে শান্ত সুস্থির লোক বলেই জানতেন, হঠাৎ এই ধরনের আদেশ পেয়ে তিনি ভাবলেন নিত্যানন্দ বুঝি পাগল হয়ে গেছে। তিন দিনের মধ্যে যখন কোনও উত্তর এল না, নিত্যানন্দ একটা অর্ডিনারি আর একটা এক্সপ্রেস পর পর দুটি টেলিগ্রাম পাঠালেন। বন্ধুটি তখন ব্যস্ত হয়ে পাগল ক্ষ্যাপানো আর উচিত হবে না এই ভেবে পর পর সাতদিন ধরে যথারীতি বন্ধুকৃত্য পালন করলেন।
বলাই বাহুল্য, ইতিমধ্যে নিত্যানন্দবাবু তার ছুটি আরও পনেরো দিন বাড়িয়ে দিলেন। একটি লম্বা চার্ট তৈরি করে খাতা বাঁধিয়ে ফেলেছিলেন তিনি। পাঠকদের অনুধাবনের সুবিধার জন্যে একদিন একবেলার চার্টটি নীচে হুবহু মুদ্রিত করা হল:
ক) তারিখ ৩০ জুন রবিবার
খ) সময় সকালবেলা ৭টা-১০টা
গ) কটকের আবহাওয়া বিজ্ঞপ্তি
ভীষণ ঝড় বৃষ্টি হতে পারে
ঘ) কটকের প্রকৃত আবহাওয়া।
উজ্জ্বল রৌদ্র, নির্মেঘ নীলাকাশ
ঙ) কলকাতার আবহাওয়ার বিজ্ঞপ্তি
উজ্জ্বল রৌদ্র, নির্মেঘ নীলাকাশ
চ) কলকাতার প্রকৃত আবহাওয়া
ভীষণ ঝড় বৃষ্টি।
সাতদিন চারবেলা করে এই রকম আটাশটি চার্ট পূর্ণ হল, অবশ্য চার্টের (চ) অংশটি পূরণ করতে দুদিন বা তিনদিন দেরি হত, কারণ ওটা পূরণ করা হত কলকাতার চিঠি পেয়ে।
আটাশটি চার্ট দেখে দেখে নিত্যানন্দ নিশ্চিত হলেন যে কটকের আবহাওয়ার পূর্বাভাস কলকাতার ক্ষেত্রে এবং কলকাতার পূর্বাভাস কটকের ক্ষেত্রে চমৎকার মিলে যাচ্ছে। যেকোনও চার্টের (গ) এর সঙ্গে (চ) এবং (ঙ) এর সঙ্গে (ঘ) মেলালেই জিনিসটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
তাঁর এই সদ্য আবিষ্কৃত তথ্য নিয়ে ছুটির পরদিনই নিত্যানন্দবাবু প্রথমে আকাশবাণীর অধিকর্তা এবং পরে হাওয়া ভবনের অধিকর্তার সঙ্গে দেখা করলেন। দুঃখের বিষয় এই দুজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারীই পাটনায়েক সাহেবকে পাগল ভেবে বসলেন। তবে তারা এ বিষয়ে আর বেশি মাথা ঘামালেন না।