কোনওরকমে একটা রিকশা ধরে মেসে ফিরে এলেন সনাতনবাবু।
০৪. আভোগ
সারারাত সনাতন মিত্রের ঘুম হল না। মেসের বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করলেন, অত শখের নতুন টু-হুইলারটা নিশ্চয় চুরি হয়ে গেল। একটা পুরো রাত কি সেটা মন্দিরের সামনে পড়ে থাকবে?
ভোর হতে না হতে আলো ফোঁটার আগেই মেস থেকে বেরিয়ে বাস রাস্তায় এলেন সনাতনবাবু। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর ভোরের প্রথম বাসের দেখা মিলল।
আধঘণ্টার মাথায় চেকপোস্ট স্টপে নেমে আবগারীশ্বরীর মন্দির। উৎকণ্ঠা ভরা হৃদয়ে দ্রুত হেঁটে মন্দিরের সামনে গিয়ে সনাতন দেখলেন মন্দিরের ফাঁকা উঠোনে শুধু তার বাহনটি কাত হয়ে পড়ে রয়েছে। দুবার চোখ কচলিয়ে বুঝতে পারলেন ঠিকই দেখছেন।
কাল রাতে বিছানায় শুয়ে মনে মনে আবগারীশ্বরীর কাছে সনাতন প্রার্থনা করেছিলেন যে যদি কোনও কারণে তিনি টু-হুইলারটি ফেরত পান একান্ন টাকার পুজো দেবেন।
তার সে প্রার্থনা মঞ্জুর করেছেন দেবী। এবার একান্ন টাকা মানতের পুজোর ব্যবস্থা করতে হয়।
তখন সদ্য মন্দিরের দরজা খুলেছে। কিন্তু বেশ ভিড়। রাস্তার ধারে সারারাত আটকিয়ে থাকা সারবন্দি ট্রাক-লরির ড্রাইভারের পুজো দিতে এসেছে।
কোনওরকমে ধাক্কাধাক্কি করে ঘণ্টাখানেক পরে একান্ন টাকার পুজো দিয়ে এক হাতে জবাফুলের মালা আর অন্য হাতে এক চাঙারি পাড়া, ঠিক কাল সন্ধ্যার সঞ্চারীর মতো সনাতন মিত্র বেরিয়ে এলেন মন্দির থেকে।
বেরোনোর মুখে মন্দিরের দেয়ালে কপাল ঠেকিয়ে জোর প্রণাম করলেন। মনে মনে ঠিক করলেন আজ বিকেলেই সঞ্চারীকে পিলিয়নে বসিয়ে একেবারে বরাকর পর্যন্ত ঘুরে আসবেন। কাল রাতের উষ্ণ সান্নিধ্যের স্বাদ এখনও শরীরে লেগে আছে।
কিন্তু মন্দির থেকে বেরিয়ে স্বপ্নভঙ্গ হল সনাতনবাবুর। কোথায় তার টু-হুইলার। এই এক ঘণ্টায় সেটা হাওয়া হয়ে গেছে। সকালবেলার রোদে আবগারীশ্বরী মন্দিরের সামনের ফাঁকা উঠোন ঝকঝক করছে। টু-হুইলার কেন, কোনও কিছুই সেখানে নেই। শূন্য উঠোনটার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন সনাতন মিত্র।
আবহাওয়া
শ্রীযুক্ত নিত্যানন্দ পাটনায়েক কটক বেতার কেন্দ্রের একজন সামান্য ঘোষক। তিনি নিউজ বুলেটিনগুলি পাঠ করে শ্রোতাদের শোনান। মূল সংবাদের সঙ্গে তার সংযোগ খুবই কম, কারণ সে সবই রাজধানী নয়াদিল্লি থেকে রিলে হয়ে আসে, স্থানীয় সংবাদ প্রচার করার সুযোগ কখনও কখনও পাটনায়েক যে পান না তা নয়, কিন্তু সেও খুবই কম। কারণ ঘোষকদের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে জুনিয়ার।
নিত্যানন্দবাবু যদিও উড়িষ্যাবাসী, উড়িষ্যাতেই তার জন্ম এবং ওড়িয়াই তার মাতৃভাষা, তবু যৌবনকালে তিনি কলকাতায় কলেজে পড়াশুনা করেছিলেন এবং স্বাভাবিক ভাবেই বাংলা ভাষা তার বেশ আয়ত্ত হয়েছিল এবং এই ভাষার প্রতি তার একটা অনুরক্তিও মনে মনে গড়ে উঠেছিল।
কটক বেতারকেন্দ্রে কাজ করতেন তিনি, কিন্তু তার কান পড়ে থাকত আকাশবাণী কলকাতায়। প্রত্যেক মুহূর্তেই কাজের ফাঁকে ফাঁকে, রেডিও স্টেশনের সেটে কলকাতা কেন্দ্রের প্রোগ্রামে কান পেতে তিনি মনে মনে তুলনা করে যেতেন কটক কতটা উঠল কিংবা নামল। কখনও তার হৃ কুঞ্চিত হত অপার বিরক্তিতে, কখনও বা একটু বঙ্কিম হাসির রেখা দেখা দিত ঠোঁটের সীমানায়।
আজ কিছুদিন হল একটা একঘেয়ে কাজের ভার পড়েছে নিত্যানন্দ পাটনায়েকের উপর। আবহাওয়া পূর্বাভাসটি তাঁকে পাঠ করতে হয়। প্রতিদিন একই ভাষায় একই রকম কয়েকটি শব্দ, মধ্যে দু-একটি হয়তো সম্ভবত জাতীয় ওড়িয়া অব্যয় ব্যবহার করে দু মিনিটের নীরস বুলেটিন।
এই আবহাওয়া বুলেটিন শুধুই যে নীরস বা একঘেয়ে কেবল তাই নয়, কয়েকদিন ঘোষণার পর নিত্যানন্দবাবু নিজেই ধরতে পেরেছেন ব্যাপারটা নিতান্তই বাজে এবং ফালতু। যেকোনও ভবিষ্যৎ বাণীর মতোই এই বাণী পুরোটাই লেগে গেলে গেল, না লাগলে লাগল না। কিন্তু অসুবিধা এই যে আবহাওয়ার ভবিষ্যৎ বার্তার ভবিষ্যৎ নিতান্তই কাজের ব্যাপার, একবারে বর্তমানের ঘাড়ের পিছনে দাঁড়িয়ে সকালে বলতে হয় বিকেলে কী হবে, বিকেলে বলতে হয় রাতে কী হবে।
আজকাল পাবলিক আছে, খবরের কাগজ আছে। তারা ভুল ঘোষণা নিয়ে হাসাহাসি করে, অম্ল-তিক্ত কটাক্ষ এমনভাবে করে, যেন আকাশবাণীর ঘোষক শ্রীযুক্ত নিত্যানন্দ পাটনায়েকেরই সম্পূর্ণ দায়িত্ব ব্যাপারটায়, যেন তার বাড়িতেই হাওয়া অফিস, সেখানে বসেই গবেষণা করে ব্যারোমিটারের পারা মেপে আর মুরগির নাচ দেখে নিজেই আবহাওয়ার বিজ্ঞপ্তি প্রস্তুত করে নিরীহ জনসাধারণকে বেকুব ভেবে আকাশবাণীর মাধ্যমে প্রচার করেন শ্রীযুক্ত পাটনায়েক।
ব্যাপারটা তো আর ঠিক তা নয়। হাওয়া অফিস থেকে ইংরেজিতে টাইপ করা বুলেটিন এসে পৌঁছায় রেডিও দপ্তরে, নিত্যানন্দবাবুর কাজ সেটিকে ওড়িয়ায় অনুবাদ করে নির্দিষ্ট সময়ে আকাশবাণী কটকে প্রচার করা।
কিন্তু অসুবিধা হল এই যে, নিত্যানন্দবাবুর নিজেরও একেক সময় ভীষণ খটকা লাগে এই বুলেটিনগুলো প্রচার করতে। ঝকঝক করছে রোদ্দুর, কটকের আকাশের একশো মাইলের মধ্যে একবিন্দু মেঘ নেই এমন টনটনে সকালে একবার গলা খাঁকারি দিয়ে যখন তাকে ঘোষণা করতে হয়, আজ সকালের দিকে প্রবল বৃষ্টিপাত হতে পারে সঙ্গে ঝড়ের সম্ভাবনা তখন যে শ্রোতার দল তাকে নিয়ে হাসাহাসি করবেই এ বিষয়ে তার বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকে না, কিন্তু তার দুঃখ হয় শ্রোতারা কি ঘোষকের কণ্ঠস্বরেও একটু সংশয়, একটু দ্বিধা খুঁজে পান না, তারা কি বুঝতে পারেন না যে এই সামান্য ঘোষক অনুবাদক মাত্র, নিতান্তই রুটিনের চাকরি তা না হলে তিনিও জানেন ঘোষণা করা উচিত ছিল, দুচার ছয় মাসের মধ্যে বৃষ্টি বা ঝড়ের সম্ভাবনা নেই, অন্তত আজ সকালের রোদ্দুর দেখে এই রকমই মনে হচ্ছে, এ সত্ত্বেও যদি বৃষ্টি হয় তার জন্যে আবহাওয়ার অফিসের কর্তারা দায়ী, কারণ তারা বলেছেন সাংঘাতিক ঝড় বৃষ্টি হতে পারে, কেন বলেছেন ঈশ্বর জানেন, শ্রোতারাও তাদের কাছে জানতে চাইতে পারেন।