ঠিক এই পর্যন্তই সনাতনের সঙ্গে তার সম্পর্ক। এর চেয়ে একটুও বেশি নয়। সঞ্চারীর মনের কথা বলা যাবে না, কথাবার্তা তো একটু বেশি হলে সনাতনের আপত্তি ছিল না।
এর মধ্যে একটা কাণ্ড ঘটল। নিজের পুরনো সাইকেলটা বেচে দিয়ে অফিস থেকে স্কুটার অ্যাডভান্স নিয়ে তিনি একটা টু-হুইলার কিনে ফেললেন।
এই টু-হুইলার কেনার পর কারখানায় বা মেসে না হলেও সঞ্চারীর কাছে সনাতনের গুরুত্ব খুব বেড়ে গেল। টু-হুঁইলারে দু তিনদিন সনাতন মিত্রকে দেখার পর সঞ্চারী আর লোভ সামলাতে পারল না। সনাতনকে বলেই বসল, সনাতনদা আমাকে একটু পিলিয়নে চড়াবেন।
পেছনের বসার জায়গাটা যে পিলিয়ন বলে সেটা সনাতন মিত্র সঞ্চারীর কাছে শিখলেন এবং পিলিয়নে সঞ্চারীকে নিয়ে আসানসোল শহর একপাক ঘুরে নিয়ে পরে পথে নেমে সঞ্চারীকে আলুকাবলি, লস্যি খাওয়ালেন।
এসবের চেয়ে বড় কথা সঞ্চারীকে বসিয়ে অভূতপূর্ব এক শিহরণ বোধ করলেন সনাতনবাবু। এরকম অভিজ্ঞতা এই সামান্য জীবনে আর কখনও হয়নি বিশেষ করে যখন উঁচুনিচু এবড়ো-খেবড়ো রাস্তায় টু-হুইলার ঝাঁপিয়ে ঝাঁপিয়ে উঠছিল। এস্তা সঞ্চারীর বাহুবন্ধন কঠিন হয়ে যাচ্ছিল। সেই স্পর্শ, সেই সুখানুভূতি সনাতন মিত্রকে আবিষ্ট করে ফেলল।
কিন্তু সনাতন মিত্র একটা মহাপাপ করেছিলেন। নতুন গাড়ি কেনার পর প্রথামত আবগারীশ্বরীর মন্দিরে পুজো দিয়ে জবাফুলের মালা পরাতে হয়, নিজের কপালে এবং গাড়ির কপালে সিঁদুরের ফোঁটা দিতে হয়, সনাতন সেসব কিছুই করেননি। দোকান থেকে কিনে এনে সরাসরি চালানো শুরু করেছেন।
শুভানুধ্যায়ী বন্ধুবান্ধব, সহকর্মী বন্ধুরা বারণ করেছিলেন, পরামর্শ দিয়েছিলেন আবগারীশ্বরীর মন্দিরে পুজো দিয়ে দ্বিচক্রযানটিকে বিশুদ্ধ করে নিতে। কোনওরকম ফঁড়া বা দুর্ঘটনার যোগ থাকলে তা হলে নিশ্চয় কেটে যেত।
কিন্তু অধার্মিক সনাতনবাবু সেসব কথা মান্য করেননি। সুতরাং যা হওয়ার তাই হল।
টু-হুইলার কেনার সাতদিনের মধ্যে পরপর দুটো দুর্ঘটনায় পড়ে গেলেন সনাতন মিত্র। সন্ধ্যাবেলা চালাতে গিয়ে রাস্তায় বাম্প ছিল খেয়াল করেননি, একদম গাড়ি সুদ্ধ ছিটকিয়ে রাস্তার মধ্যিখানে চিত হয়ে পড়ে গেলেন তিনি।
আরেকদিন একটা লরির পাশ কাটাতে গিয়ে উলটোদিকের একটা দ্রুতগামী ম্যাটাডোরের মুখে পড়ে গেলেন তিনি, কী করে যে সেদিন প্রাণ রক্ষা হয়েছিল ভাবতে গেলে এখনও সনাতনবাবুর হৃৎকম্প হয়।
এই দ্বিতীয় দিনে আবার সনাতনবাবুর পিলিয়নে ছিলেন তাঁরই মেসের এক বন্ধু জগৎলাল।
জগৎলাল সনাতনবাবুকে চেপে ধরলেন, অবিলম্বে আবগারীশ্বরীর পুজো দিয়ে বাহনটিকে বিপদমুক্ত করতে হবে। না হলে সমূহ সর্বনাশ হবে।
সুতরাং অনেক কিছু ভেবেচিন্তে পরের অমাবস্যার সন্ধ্যায় টু-হুইলারটি নিয়ে সনাতনবাবু। আবগারীশ্বরীর মন্দিরে গেলেন। একাই গেলেন, তার এই ধর্মকর্মের তিনি কোনও সাক্ষী রাখতে চান না।
গেঁজেল মাতালদের ভিড় রাতের দিকে বাড়ে, তাই সূর্যাস্তের পরে পরেই ভাল করে অন্ধকার। হওয়ার আগেই তিনি মন্দিরে পৌঁছে গেলেন। মন্দিরের মুখে অনেকগুলো টু-হুইলার, ট্রাক, লরি, এমনকী নতুন সাইকেল এসে গেছে, পুজো দেওয়ার জন্যে। সনাতনবাবু দেখলেন তাদের কোম্পানির জিপটাও তার মধ্যে রয়েছে।
টু-হুইলারটা ঠিকমতো রেখে সনাতন মন্দিরের মধ্যে ঢুকতে যাবেন এমন সময় দেখেন সঞ্চারী মন্দির থেকে বেরোচ্ছে, তার হাতে জবার মালা, শালপাতার ঠোঙা ভর্তি প্যাঁড়া, সঙ্গে বেশ কয়েকজন বন্ধুবান্ধবী। তাদেরও কারও কারও হাতে ওইরকম ঠোঙা, জবাফুলের প্রসাদী মালা।
হঠাৎ এমন জায়গায় সনাতনকে দেখে খুবই খুশি হল সঞ্চারী, ওমা, সনাতনদা আপনি এখানে। খুব লুকিয়ে লুকিয়ে পুজো দেন, তাই না। আজ ধরা পড়ে গেছেন। নিশ্চয়ই আপনার গাড়ির পুজো দিতে এসেছেন।
সত্যিই তো, এই তো সেদিনই পিলিয়নবাহিনী সঞ্চারীকে সনাতন বুঝিয়েছেন, সবাই যা করে তা আমি করি না। কোনও রকম পুজো না দিয়েই আমি আমার টু-হুইলার চালাচ্ছি। এসব ব্যাপারে আমার কোনও সংস্কার নেই।
ভাগ্যিস অন্যান্য স্কুটার ও গাড়ি ইত্যাদির ভিড়ে এখন সনাতনবাবুর টু-হুইলারটি চোখের আড়ালে পড়ে গেছে, তাই যে মুহূর্তে সঞ্চারী তার বন্ধুদের বলল, তোমরা চলে যাও, আমি সনাতনদার সঙ্গে ফিরব। সনাতন বলে বসলেন, সে কী করে হবে? আমার গাড়ি তো সঙ্গে আনিনি। আমি বাসে ফিরব।
ব্যাপারটা কিন্তু আরও বেকায়দা হয়ে গেল। সনাতনবাবুর এই কথায় সঞ্চারী তাকে জোর করতে লাগল, আমাদের জিপ থাকতে আপনি বাসে ফিরবেন কেন? আপনি আমাদের সঙ্গে জিপে উঠে আসুন।
সনাতনকে সঞ্চারী প্রায় হাত ধরে টেনে জিপে তুলল। জিপের পিছনের সিটের শেষপ্রান্তে সঞ্চারীর উষ্ণ শরীর ঘেঁষে বসে হাইওয়ের উদ্দাম হাওয়ার মধ্যেও তিনি ঘামতে লাগলেন।
সঞ্চারীর সঙ্গে তাদের বাড়িতে যেতে হল। আবগারীশ্বরীর পুজোর প্রসাদী প্যাঁড়া খেতে হল। কিন্তু এদিকে সারাক্ষণ সনাতনবাবুর মনটা খুঁত খুঁত করছিল নতুন টু-হুইলারটা মন্দিরের ওখানে পড়ে রইল। চুরি-টুরি না হয়ে যায়। তবু এই মুহর্তে তার পক্ষে আর কিছু করার ছিল না। সঞ্চারীদের বাড়ি থেকে বেরোতে বেরোতে রাত দশটা বেজে গেল। তখন লাস্ট বাসটাও চলে গেছে। এই রাতে দশ-এগারো মাইল রাস্তা উজিয়ে আবগারীশ্বরীর মন্দিরে যাওয়া অসম্ভব।