তা সাইকেলেই হোক অথবা পায়ে হেঁটেই হোক, মেস থেকে কারখানা যাতায়াতের রাস্তা একটাই। সেই পথে কারখানা থেকে একটু এগিয়ে ঠিক কারখানায় ঢোকার পথের মুখে একটা হনুমানজির মন্দির আছে। খুবই জাগ্রত মন্দির। তার সামনের উঠোনে কারখানার দারোয়ানরা সকাল সন্ধে জয় বজরঙ্গবলী বলে ঊরুতে থাপ্পড় দিয়ে কুস্তি লড়ে।
কারখানার সমস্ত কুলি কামিন, বাবু-অফিসার এই হনুমানজির মন্দির পেরোবার সময় প্রণাম করে। কেউ যেতে যেতে কপালে হাত ঠেকিয়ে কেউ মনে মনে, কেউ বা গড় হয়ে আবার অতি ভক্তিমানরা সাষ্টাঙ্গে প্রণতি জানায়।
তা ছাড়া বড় রাস্তার মোড়ে রয়েছে নবগ্রহ মন্দির। শিল্পাঞ্চলের গরিব মানুষদের মনে ভাগ্য, তুকতাক এই সব নিয়ে, তন্ত্রে-জ্যোতিষীতে খুবই বিশ্বাস। নবগ্রহ মন্দিরেও দিনরাত ভিড় লেগেই আছে। এমনকী সনাতনবাবুর বন্ধুদের, সহকর্মীদের মধ্যে এমন অনেকে আছেন যাঁরা নবগ্রহ মন্দিরের দেয়ালে পরপর তিনবার মাথা না ঠুকে কারখানায় যান না। তার জন্যে তাদের কারখানায় ঢুকতে লেট হলেও তারা সেটা মেনে নেন।
কিন্তু মাথা ঠোকা বা কপাল ছোঁয়ানো তো দূরের কথা সনাতনবাবু পায়ে হেঁটে বা সাইকেলে যাতায়াতের পথে হনুমানজির বা নবগ্রহ মন্দিরে কখনও প্রণাম জানান না। অনেকে এসব জায়গায় থেমে, সাইকেল বা হাঁটার গতি কমিয়ে মনে মনে কিংবা ঠোঁট বিড় বিড় করে দেবতাকে নমো করেন।
সনাতনবাবু এসব কখনওই করেননি। এমনকী কাছেই বিহার বর্ডারে আন্তরাজ্য একসাইজ চেকপোস্টের পাশে এক জাগ্রত দেবী রয়েছেন। দূর দূরান্ত থেকে লোকজন, দেহাতি মানুষ সেখানে পুজো দিতে আসে।
দেবীর নাম আবগারীশ্বরী। কলকাতা হাইকোর্টে যেমন এক শিবলিঙ্গ আছে। লর্ড হাইকোর্টেশ্বর; কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরানো বটতলায় ছিল বিশ্বেশ্বরী, ঠিক তেমনই আবগারীশ্বরী।
এই রাস্তায় আবগারির মানে একসাইজের বাবুদের বড় অত্যাচার। এই চেকপোস্টে নজরানা না দিয়ে এ রাস্তা দিয়ে যাওয়া কঠিন। সরকারি নীতির সঙ্গে সঙ্গে আবগারির থাবা ক্রমশ বড় হচ্ছে, বিশেষ করে বিহার এলাকায় শুধু গাঁজা-ভাং, মদ বা মাদকদ্রব্য নয়, আবগারির আওতায় ওষুধ থেকে দেশলাই, প্রসাধনী থেকে বিলাস দ্রব্য অনেক কিছুই এসে গেছে।
রাস্তায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাড়ি দাঁড় করিয়ে রাখা বিশাল বিশাল হিন্দি ফর্ম পূরণ করতে দেওয়া। মালপত্তর কিছু লোপাট করা তদুপরি নগদ অর্থ-আবগারির বাবুদের খাই বড় বেশি।
স্বাভাবিক কারণেই পাঞ্জাবি ধাওয়া, ভাতের হোটেল, পানের দোকান এবং এই বড় মন্দিরটি গড়ে উঠেছে। এই মন্দিরের জাগ্রত দেবী আবগারীশ্বরীর পুজো দিলে চেকপোস্ট থেকে তাড়াতাড়ি পরিত্রাণ পাওয়া যায়। শোনা যায়, আবগারীশ্বরীর প্রধান পুরোহিত চেকপোস্টের দারোগাবাবুর যমজ ভাই। দুজনে নাকি একইরকম দেখতে।
দুষ্ট লোকে বলে, এই দুজনে নাকি একই লোক। কারণ দারোগাবাবুকে আর পুরোহিতমশায়কে কখনও নাকি একসঙ্গে পাশাপাশি বা মুখোমুখি দেখা যায়নি। তা ছাড়া একজনের পরনে খাকি ইউনিফর্ম, বুট জুতো, মাথায় বারান্দা টুপি। অন্য জনের খালি গা, কপালে সিঁদুরের ফোঁটা, পায়ে খড়ম, মাথায় টিকি। দুজনের মধ্যে চট করে মিল খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়।
যেমন হয় বিভিন্নরকম গাড়ি ড্রাইভারের মারফত আবগারীশ্বরী এই এলাকার চারদিকে বিখ্যাত হয়ে পড়েছে। যথারীতি তার কিছু মহিমা ও বিভূতির কথাও শোনা যাচ্ছে। শুধু ড্রাইভাররা নয়, সাধারণ মানুষ যাদের আবগারির চেকপোস্টে কোনও কাজ নেই, তারাও যাচ্ছে দেবীকে প্রণাম করতে। প্রতি অমাবস্যার রাতে মেলা বসছে দেবীমন্দির ঘিরে। পাঁঠা বলি হচ্ছে, ঢাক বাজছে, রাস্তায় হাইপাওয়ার লাইন থেকে তার টেনে বিদ্যুতের আলোয় চারপাশ ঝলমল করছে। এইসব রাত আবগারি মুক্ত। একসাইজ ফ্রি। মদের ফোয়ারায়, গাঁজার কুণ্ডলিতে আচ্ছন্ন হয়ে যায় মেলা প্রাঙ্গণ।
এদিকে আরেকটা খ্যাতি হয়েছে আবগারীশ্বরীর। ড্রাইবারদের কল্যাণেই সেটা হয়েছে। নতুন গাড়ি কিনলে, লাইসেন্স নিলে, পারমিট নিলে আবগারীশ্বরীর পুজো বাঁধা। প্রতিমার পায়ে ছুঁইয়ে লাল জবা ফুলের মালা গাড়িতে লাগাতে হবে। দৈব দুর্ঘটনা থেকে প্রতিকারের এটাই অমোঘ উপায়।
সনাতন বাবুর সহকর্মীরা, মেসবাসীরা অনেকেই অনেকবার আবগারীশ্বরীকে পুজো দিয়ে এসেছেন। প্রণাম করে এসেছেন। অমাবস্যার রাতে গিয়ে হইহুল্লোড় করে এসেছেন, কিন্তু সনাতনবাবু তাদের সঙ্গে যাননি। পুরো ব্যাপারটা তাঁর বাজে মনে হয়েছে।
০৩. সঞ্চারী
সনাতনবাবুদের কারখানার উলটোদিকে সারি সারি কর্মচারিদের কোয়ার্টার। পুরনো আমলের লাল ইটের বাংলো ধরনের ছোট ছোট বাড়ি।
ঢুকবার মুখে সবচেয়ে প্রথম বাড়িটায় থাকেন কারখানার বড়বাবু অনিল দাস। অনিলবাবুর মেয়ের নাম সঞ্চারী। বছর কুড়ি-একুশ বয়েস হবে। গোলগাল, বেঁটেখাটো, একটু মোটাসোটা, ফরসা, আহ্লাদি গোছের মেয়ে। আসানসোলের কলেজে পড়ে।
সকালবেলা কারখানার জিপে করে আরও অনেকের সঙ্গে সে কলেজে যায়। বিকেলে একা একাই বাসে ফেরে। অনেকের সঙ্গে আলাপ আছে সঞ্চারীর। কিন্তু কাউকেই বিশেষ পাত্তা দিতে চায় না।
সঞ্চারী সনাতন মিত্রকেও চেনে, ভালই চেনে। মুখোমুখি দেখা হলে মুচকি হাসে। কখনও সম্বোধন করার প্রয়োজন হলে সনাতনদা বলে। খুচরো কথাবার্তাও হয়।