যে বছর সনাতন সঙ্কীর্তন সঙঘ এক কথায় স-সস প্রতিষ্ঠিত হয় ঠিক তার আগের বছর সনাতন জন্মান। এবং অনিবার্যভাবেই সনাতন নামটি তার কাঁধে পড়ে।
চাকুরি জীবনের শেষভাগে নিত্যপ্রসাদের মূল কাজ ছিল বিভিন্ন ধরনের ফৌজদারি মামলার আসামিকে আদালতে সোপর্দ করা।
এখানে বলা রাখা উচিত যে নিত্যপ্রসাদ অত্যন্ত ন্যায়নিষ্ঠ অফিসার ছিলেন। নিজের কাজ খুব মন দিয়ে করতেন। উৎকোচে তাঁর যে খুব অনীহা ছিল তা নয়। কিন্তু তাঁর নিজস্ব একটা বিচারবুদ্ধি ছিল। তিনি নিজে যে মামলাটা খারাপ মনে করতেন, সে মামলার আসামি তার বিচারে গর্হিত অসামাজিক কর্ম করেছে বলে তিনি ভাবতেন সেখানে খুবই কঠোর হতেন। তাঁর তদ্বির তদারকিতে অসংখ্য প্রতারক-জোচ্চোর, মদ্যপ-লম্পট শ্রীঘরবাসী হয়েছে।
আসল কথা এই যে কোর্ট ইনসপেক্টর এন পি মিত্র প্রতারণা, লাম্পট্য, ব্যভিচার ইত্যাদি সহ্য করতেন পারতেন না। তার হাতে পড়লে এদের নিস্তার ছিল না। কিন্তু সাধারণ চুরি-ডাকাতি, রাগের মাথায় খুন এই সব ধর্তব্যের মধ্যে নিতেন না। সুতরাং এদের কাছ থেকে ঘুষ নিতে তার বিবেক দংশন হত না।
পুলিশের দারোগার বিবেক দংশন এই কথাটা হয়তো কারও কারও কাছে গোলমেলে ঠেকতে পারে। তাদের অবগতির জন্যে জানাই যে পুরুষানুক্রমে ধর্মপরায়ণ বংশের সন্তান শ্রীযুক্ত নিত্যগোপাল মিত্র নিজেও চিরকালই খুব ধর্মপ্রাণ ছিলেন। প্রথম যৌবনে সেই যুদ্ধের বাজারে যখন চিনি ও চিনিজাত সব দ্রব্য অদৃশ্য হয়ে গেছে তিনি সখেরবাজারে বাতাসাপট্টি ঘুরে ঘুরে তার উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত গৃহদেবতা গোপালঠাকুরের জন্যে সাদা বাতাসা কিনে আনতেন। প্রতিবার কাজে বা অকাজে বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় অষ্টধাতু নির্মিত গৃহদেবতার মুখে একটি সাদা বাতাসা গুঁজে দিয়ে বেরোতেন।
বেশি বয়েসে রিটায়ার করার মুখে এন পি মিত্র অতিশয় ধর্মপ্রবণ হয়ে পড়েন। গঙ্গার ঘাটের হিন্দুস্থানি কুলিদের আখড়ার বজরং ব্যায়ামগার থেকে শুরু করে আট হাজার আটশত আটবার অবিরাম হরিনাম সমিতির সঙ্গে তিনি যুক্ত হন।
রিটায়ার করার পর এন পি মিত্র নিজ উদ্যোগে অবিরাম হরিনাম সমিতির নাম বদল করে সনাতন সঙ্কীর্তন সঙঘ নামে রেজিস্ট্রি করেন এবং নিজে তার সভাপতিত্ব গ্রহণ করেন।
সেই সময় সনাতন নিতান্ত শিশু। পিতামহের অতি আদরের পৌত্র। আদরের আতিশয্যে এখন আজীবন সনাতনকে নামের বোঝাটি বহন করে যেতে হচ্ছে।
০২. অন্তরা
আসানসোল থেকে একটু এগিয়ে ধানবাদের পথে বঙ্গ-বিহার সীমান্তের কিঞ্চিৎ আগে একটি সদাব্যস্ত অঞ্চলের অনতিখ্যাত কিন্তু সুচালু কারখানার সহকারী ফোরম্যানের কাজ করেন সনাতন। তার ভাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি নেই। একটি ডিপ্লোমা আছে কিন্তু কাজ জানেন, নিজের কাজটা খুব ভালভাবেই জানেন। সেখানে তার যোগ্যতা অনস্বীকার্য। তা ছাড়া শক্ত সমর্থ যুবক, লোহাপেটা শরীর। কোম্পানিতে সনাতন মিত্রের সুনাম ও কদর দুই-ই আছে।
সনাতন মিত্র যে কোম্পানিতে কাজ করেন, সেটি খুব বড় না হলেও পুরনো এবং ভাল। কোনও উটকো, কাঁচা টাকায় হঠাৎ গজিয়ে ওঠা ব্যাঙ্ক ঠকানো কারখানা নয়।
কারখানার কর্মচারিদের জন্যে একটা পুরনো আবাসন ব্যবস্থা আছে। কিন্তু ব্যাচেলারদের কোয়ার্টার দেয়া হয় না। তাদের জন্যে তিন কিলোমিটার দূরে কোলিয়ারি গঞ্জে একটা দোতলা বাড়ি ভাড়া নেয়া আছে। সেটাই হল ব্যাচেলারস মেস।
এই মেসেরই একটা ঘরে সনাতন মিত্র থাকেন। কলকাতার সখের বাজারে তাদের সাবেকি বাড়িতে সনাতনবাবুর দাদা-বউদি, বাবা-মা, অনূঢ়া দিদি রয়েছেন। সনাতনবাবু আর তার এই অনূঢ়া দিদিটি পিঠোপিঠি ভাইবোন।
দিদিটির নাম অনুরাধা। পিতামহ প্রদত্ত নাম ছিল নিতান্তই রাধা। সেকেন্ডারি পরীক্ষার ফর্ম পূরণ করার সময় বড়দিমণি মানে প্রধান শিক্ষিকা মহোদয়ার হাতে পায়ে ধরে রাধা অনুরাধা হয়েছিল। তবে রাধা নামটা আজও বহাল আছে, সেটা ডাকনাম হিসেবে।
সেই রাধা কিংবা অনুরাধার বিয়েতে একদম মন নেই। কিন্তু ভালবাসার দিকে খুব ঝোঁক। আজ পর্যন্ত তিরিশ-চল্লিশ বার তিনি প্রেমে পড়েছেন, এমনকি একই ব্যক্তির সঙ্গে পাঁচ-সাতবার। তবে পুরো ব্যাপারটাই মানসিক, মৌখিক, ওই সেই যে রজকিনী প্রেম, কীসের গন্ধ যেন তাতে নেই। সেই ব্যাপার আর কী!
দিদির বিয়ে না হলে সনাতন বিয়ে করেন কী করে? তাই তাঁরও বিয়ে হয়নি। দিদির যা মনোভাব দেখা যাচ্ছে তাতে সদ্য সদ্য সেরকম কোনও সম্ভাবনাও নেই।
সে যা হোক, অনুরাধাদির কাহিনি এখানে প্রক্ষিপ্ত। সনাতন মিত্রের কথা বলি। গল্পের প্রথমেই তাকে অধার্মিক বলেছি। ভাবনাটা ব্যাখ্যা করা দরকার।
সনাতন মিত্রের মতো একজন পঁচিশ-তিরিশ বছর বয়েসের যুবকের আবার ধর্মান্ধতা কী? এ বয়েসে আজকাল কেউ টিকিও রাখে না, তিলকও কাটে না, ত্রিসন্ধ্যা জপ-আহ্নিক করার করার প্রশ্নও আসে না।
আর একবারও অস্বীকার করার উপায় নেই যে আর দশটি স্কুল কলেজের ছেলের মতোই সনাতন পরীক্ষার সময় কপালে দইয়ের ফোঁটা দিয়ে ঠাকুর প্রণাম করে পরীক্ষার হলে যেতেন। কলকাতায় থাকতে রাস্তাঘাটে যাতায়াতের পথে মন্দির পড়লে আর দশজনের মতোই চোখ বুজে হাত জোড়া করে কপালে ঠেকাতেন।
আসানসোলের এই কাঠখোট্টা, খরা অঞ্চলে এসে ধর্মভাবটা কী করে যেন বিদায় নিয়েছে সনাতন মিত্রের কাছ থেকে। সনাতনবাবুও ব্যাচেলারস মেস থেকে কারখানার পথটুকু কাজে ঢুকে প্রথম প্রথম হেঁটেই চালিয়ে দিচ্ছিলেন। বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ মাসে এ অঞ্চলে গরম সাংঘাতিক। বেলা উঠতে না উঠতে চারদিক তেতে ওঠে। রোদ্দুর ঝাঁঝ করে। তখন রাস্তায় হাঁটা খুব কষ্ট। যাতায়াতের সুবিধের জন্যে কিছুদিন পরে একটা সাইকেল কিনেছিলেন।