মা-দিদিমার ধাতটা সুদর্শনবাবুও পেয়েছেন। সব কারণেই তার হাসি পায়। ডাক্তারবাবুর হাসতে নিষেধ থাকা সত্ত্বেও সুদর্শনবাবু ভেবে দেখলেন যে তার মা যদি মাথা ফেটে গেলেও হাসতে পারেন তিনি কেন মাথা ধরা নিয়ে হাসতে পারবেন না। কিন্তু ব্যাপারটা বেশ কষ্টের ব্যাপার।
পূর্বজন্মের গুণ বলে একটা কথা প্রচলিত আছে। সুদর্শনবাবু নিশ্চয়ই বড় ডাক্তারবাবুর কাছে আগের জন্মে অনেক টাকা ধার করেছিলেন। এ জন্মে সেটা শোধ না দিয়ে অব্যাহতি নেই।
তাই এর পরেও আরেকদিন সেই বড় ডাক্তারবাবুর কাছে যেতে হল সুদর্শনবাবুকে। তিনি ইতিমধ্যে সুদর্শনবাবুকে মোটামুটি বুঝে ফেলেছেন। আজ ভদ্রতার খাতিরে আর ভিজিট নিতে চাইলেন না। কিন্তু সুদর্শনবাবু জোর করে একটা একশো টাকার নোট ডাক্তারবাবুর টেবিলে পেপার ওয়েট চাপা দিয়ে রেখে দিলেন। তিনি বিচক্ষণ লোক। তিনি জানেন ডাক্তারের ভিজিট আর উকিলের ফি সব সময়েই দেওয়া উচিত। তাতেই মঙ্গল হয়।
সে যা হোক, আজ মহা দুর্যোগের দিন। বাইরে চারদিক কালো করে প্রবল বৃষ্টি হচ্ছে। ডাক্তারবাবুর চেম্বারে আজ ভিড় নেই। সর্বশেষ রোগী এক সুদর্শনবাবুই রয়েছেন। আজ সুযোগ পেয়ে তিনি ডাক্তারবাবুর সঙ্গে মন খোলসা করে আলোচনা করলেন।
সুদর্শনবাবু বললেন, ডাক্তারবাবু আপনার পরামর্শ মেনে যে চলা যাচ্ছে না।
ডাক্তারবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, কী পরামর্শ?
সুদর্শনবাবু বললেন, ওই যে আপনি বলেছিলেন না, ওই যে না-হাসতে বলেছিলেন।
ডাক্তারবাবু বললেন, হাসলে আপনার কষ্ট হয় তাই আপনাকে হাসতে বারণ করেছিলাম।
সুদর্শনবাবু বললে, না হেসে যে পারি না। হাসব না ভাবলে আমার যে আরও বেশি হাসি পায়।
ডাক্তারবাবু প্রশ্ন করলেন, কিন্তু আপনি বলেছিলেন না বেশি হাসলে আপনার যন্ত্রণা বেশি হয়, ব্যথা বাড়ে।
সুদর্শনবাবু জানালেন, খুব কষ্ট হয়। খুব ব্যথা হয়।
ডাক্তারবাবু বললেন, তা হলে আপনি হাসবেন কেন? এত কী হাসির ব্যাপার আছে। কীসে আপনি হাসেন।
সুদর্শনবাবু স্বীকার করলেন যে, বাজারে জিনিসপত্রের দাম শুনলে তার হাসি পায়। খবরের কাগজের খবর পড়লে, নেতাদের বক্তৃতা শুনলে তার হাসি পায়। হাসির গল্প পড়লে, হাসির সিনেমা বা সিরিয়াল দেখলে তার হাসি পায়। দুঃখের গল্প পড়লে, দুঃখের সিনেমা বা সিরিয়াল দেখলে তিনি হাস্য সম্বরণ করতে পারেন না।
সব শুনে ডাক্তারবাবু বললেন, কিন্তু আপনাকে তো হাসলে চলবে না। একটু সাবধানে থাকতে হবে। আচ্ছা আপনি কি ভেবে দেখেছেন এই যে এত পশুপাখি এরা কখনও হাসে না। কুকুর হাসে না, বিড়াল হাসে না, কাক হাসে না, কোকিল হাসে না, গোরু-ঘোড়া, বাঘ-সিংহ এমনকী হায়েনা পর্যন্ত হাসে না। অথচ এদের না হেসে কোনও অসুবিধে হচ্ছে না। যে যার মতো বেশ তরতাজা থাকছে, খাচ্ছে-দাচ্ছে, ঘুমোচ্ছে। না হেসে জীব জগতের এদের কারও বিন্দুমাত্র অসুবিধে বা ক্ষতি হচ্ছে না। তা হলে আপনি কেন হাসবেন? লতা-পাতা গাছ কেউ কখনও হাসে না, তবু আপনাকে হাসতে হবে?
ডাক্তারবাবুর এই বক্তৃতা শুনে ছোট করে অট্টহাস্যে ভেঙে পড়লেন সুদর্শনবাবু। হাসতে হাসতে মাথার যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠতে উঠতে সুদর্শনবাবু বললেন, কিন্তু আমি যে মানুষ। না হেসে আমার যে কোনও গতি নেই। না হেসে আমার কোনও উপায় নেই।
এই বলে ডাক্তারবাবুর চেম্বারের মেঝেতে পেটে হাত দিয়ে হেসে গড়াতে গড়াতে সেই সঙ্গে মাথার ঝুঁকিতে অসহ্য যন্ত্রণায় গোঙাতে লাগলেন সুদর্শনবাবু। তাঁর বক্তৃতার পরিণতি দেখে ডাক্তারবাবু স্তম্ভিত। এর চেয়েও অবাক কাণ্ড হো-হো করে হাসতে হাসতে হঠাৎ এক সময় যন্ত্রণার গোঙানিটা থেমে গেল সুদর্শনবাবুর। তিনি টের পেলেন যন্ত্রণাটা মাথা থেকে চলে গেছে। ডাক্তারবাবুও বুঝতে পারলেন তার সেই পুরনো রোগী এই মাত্র রোগমুক্ত হয়েছেন।
কিন্তু কী করে সেটা সম্ভব হল সেটা তিনি ধরতে পারলেন না।
ধরতে পারলেও তেমন কোনও সুবিধে ছিল না।
শুধু হাসতে হাসতে আধকপালের কঠিন অসুখ সেরে যেতে পারে ডাক্তারবাবুর পক্ষে সেটা ভাবা কঠিন।
আবগারীশ্বরী
০১. স্থায়ী
বঙ্গীয় কুলীন কায়স্থ বংশে, একটি প্রাচীন রক্ষণশীল পরিবারে শ্রীযুক্ত সনাতন মিত্রের জন্ম।
কিন্তু নিতান্ত দুঃখের বিষয় এই যে সনাতনবাবু মানুষটি যাকে ধার্মিক বা ধর্মপরায়ণ লোক বলে ঠিক সেই ধরনের নন। পুজো-আর্চায় তাঁর মোটেই মন নেই। দেবদ্বিজে বিগ্রহে-প্রতিমায় তাঁর ভক্তি অচলা নয়।
তবে এসবের জন্যে একটা বয়েস লাগে। সে বয়েসে পৌঁছাতে এখনও সনাতনবাবুর ঢের দেরি আছে। সনাতন নামটি ঊনবিংশ শতকীয় হলেও তার বাহক মোটেই ঊনবিংশ শতকের নয়। এই নামটি শুনে যার মনে যাই হোক, ভুল ধারণা পোষণ করে লাভ নেই। আমাদের এই অকিঞ্চিৎকর আখ্যানের প্রাণপুরুষ উক্ত শ্রীযুক্ত সনাতন মিত্রের বয়েস এখন সদ্য বিশের ধাপ গুটি গুটি পার হয়ে তিরিশাভিমুখী, উচ্ছল কুড়ি আর উজ্জ্বল তিরিশের মধ্যের দরজায় তিনি দাঁড়িয়ে।
বলা বাহুল্য, এই সনাতন নামকরণটির পিছনে একটি ক্ষুদ্র ইতিহাস রয়েছে।
স্বর্গীয় নিত্যপ্রসাদ মিত্র ছিলেন সনাতনবাবুর পিতামহ। তিনি কর্মজীবনে পুলিশ কোর্টের দারোগা বা কোর্ট ইনসপেক্টর ছিলেন কিন্তু অনেক পুলিশ দারোগার মতোই তিনি খুব ধার্মিক প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। সনাতন সঙ্কীর্তন সঙ্ঘ-এর তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা এবং আমৃত্যু সভাপতি।