কেমন সন্দেহ হওয়াতে তক্ষুনি চাকরবাকর নিয়ে লণ্ঠন জেলে দেখতে বেরুলাম। পায়খানা বাড়ি থেকে একটু দূরে, উঠোন পেরিয়ে যেতে হয়। তার পরেই পচিল। এদিকের দরজা দিয়ে বেরিয়ে ঘুরে সেখানে পৌঁছে দেখি কোথাও কিছু না। পাঁচিলের পরেই ঘন ঝোপঝাড় আর আগাছার জঙ্গল। সেখানে বসে এই ভর-সন্ধ্যেয় কে কাঁদতে যাবে? কিন্তু কি বলব ঠাকুরমশায়, ফিরে আসতে গিয়ে পরিষ্কার শুনলাম কে যেন খুব আকুল হয়ে কাঁদছে, স্ত্রীলোকের গলা। খুব কষ্টের কান্না। আবার ফিরে যাই, আবার দেখি। নাঃ, কোথাও কিছু নেই। একবার মনে হল শব্দটা যেন বাড়ির ভেতর থেকে আসছে। কেমন ভয় ধরে গেল—এসব কি কাণ্ড? এমন হওয়া তো ভাল কথা নয়।
পরের দিন গিন্নীকে কোলকাতায় ফেরত পাঠালাম মেজ ছেলের সঙ্গে। আমি আর শচী আরও দুদিন থেকে গেলাম। প্রত্যেক দিন সন্ধ্যেবেলা সেই কান্নার শব্দ শুনেছি। আর, কি বলব, বাড়িটার মধ্যে যতক্ষণ থাকি মন যেন কেমন বিষণ্ণ হয়ে থাকে। বুকে যেন একটা পাহাড়ের মত চাপ টের পাই। বাড়িটা ভাল নয় ঠাকুরমশায়। কিন্তু একগাদা টাকা খরচ করে কেনা বাড়ি যাওয়া বন্ধ করলে তো পোড়ো হয়ে যাবে। অনেক শখ করে কেনা। এর কিছু উপায় হয়?
একটু ভেবে বললাম—আমাকে একবার নিয়ে যেতে পারেন সেখানে?
—আজ্ঞে হ্যাঁ, তা পারি বইকি। আর সত্যি বলতে কি, আমি জানতাম আপনি যেতে চাইবেন। আমার মনে হয়েছিল। আপনি ভাববেন না কিছু, আপনার যাতায়াত, খাওয়া-দাওয়া এবং গরিবের সাধ্যমতো দক্ষিণ আমি দেব। কবে যাবেন বলুন?
—আপনার কবে সুবিধা হয়?
পরশু সকালে তৈরি হয়ে থাকবেন। আমি এসে নিয়ে যাব।
রাজবলহাট থেকে মাইল তিনেক দূরে মতিপুর গ্রাম। বিকেল তিনটে নাগাদ গিয়ে সেখানে পৌঁছলাম। নিতান্ত পাড়াগা বটে, কিন্তু বাড়িখানা সত্যি দেখবার মত। বিরাট দোতলা বাড়ি। একটা বার-বাড়ি, একটা ভেতরের মহল। সব মিলিয়ে প্রায় তেইশ-চব্বিশখানা ঘর। কাছাকাছি আর অন্য বসতি নেই। মূল গ্রাম কিছুটা দূরে।
আদর করে রামদুলাল আর শচী আমাকে ভেতরে নিয়ে গেল। কিন্তু কি জাননা, বাড়িতে ঢুকেই আমার মনে হল—এখানে কোন গোলযোগ আছে। ঠিক কি যে হল, তা বলতে পারব না। তবে মনে একটা অস্বস্তির ভাব। চারদিকে বাতাস যেন এ বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে এসে আর বইছে না, একটাও পাখির ডাক নেই-গেরস্তর বাড়ি এমন। শ্মশানের মত হবে কেন? ওই পাখির ডাক না শুনতে পাওয়াটা আমাকে সত্যি ভাবিয়ে তুলল। আমি দেখেছি মানুষের চেয়ে নিম্নস্তরের প্রাণীরা অশুভ প্রভাব সম্বন্ধে বেশি অনুভূতিপ্রবণ হয়। ভূমিকম্প হবার আগে পোষা পাখি খাচার মধ্যে ছটফট করে জানো? মোটের ওপর সেখানে পৌঁছে বুঝতে পারলাম রামদুলাল বাজে কথা বলেনি।
যাই হোক, চাকর তক্ষুনি হাত-পা ধোবার জল এনে দিল। জামা-কাপড় বদলে আমি, রামদুলাল আর শচী বৈঠকখানায় এসে বসলাম। কোলকাতা থেকে চাঙাড়ি করে একগাদা খাবার এনেছিল রামদুলাল। এবার চাকর সেগুলো আমাদের পরিবেশন করে দিল। প্রচুর খাটি ঘিয়ে ভাজা লুচি, আলুর দম, বড় বড় জোড়া সন্দেশ, ছানার মুড়কি ইত্যাদি। বেশ খিদে পেয়েছিল। এক নিঃশ্বাসে প্রচুর খেয়ে ফেলার পরে যখন একটা হাড়ি থেকে রাবড়ি বেরুল, ভয় পেয়ে বললাম—না, আর নয়। অনেক হয়েছে।
রামদুলাল হাত জোড় করে বলল—আজ্ঞে, কি আর এমন আয়োজন? খুদকুঁড়ো বই তো নয়। সামান্য একটু নিন। আপনার কথা ভেবেই আনা–
খাওয়া হলে রামদুলাল বলল—একটা কথা বলব।
–-কি?
—কিছু বুঝতে পারছেন? বাড়িটায় কি সত্যি কোন দোষ আছে?
আসল কথা না ভেঙে বললাম—এখনই কিছু বলা কঠিন। দেখি আজ রাতটা।
সন্ধ্যের অন্ধকার যখন বেশ গাঢ় হয়ে এসেছে, তখনই আমি কান্নার শব্দটা শুনতে পেলাম। আমার সামনে বসেছিল রামদুলাল। দেখলাম তার মুখ নিমেষে রক্তহীন সাদা হয়ে গেল। আমাকে বলল—ওই, ওই শুনছেন? সেই শব্দ–
বেশি করে বলবার দরকার ছিল না। কোথা থেকে যেন ভেসে আসছে একটা করুণ কান্নার শব্দ। স্ত্রীলোকের কান্নাই বটে। যেন খুব কষ্টে গুমরে গুমরে কাঁদছে। কোথা থেকে আসছে শব্দটা? একবার মনে হচ্ছে বাইরে থেকে, আবার মনে হচ্ছে খুব বেশি দূরে নয়—কাছাকাছিই বসে কাঁদছে কেউ।
—বাবা!
দরজার কাছে শচীদুলাল এসে দাঁড়িয়েছে।—বাবা, শুনেছেন?
রামদুলাল কাঁপা গলায় বলল—শুনেছি, তুই ভেতরে চলে আয়।
বললাম—ভয় পেয়ো না, দাঁড়াও। আমাকে একটা লণ্ঠন দাও তো।
চাকরটাও ভয় পেয়ে চলে এসেছে। তার হাতে একটা হ্যারিকেন। সেটা নিয়ে ঘর থেকে বেরুতে বললাম—তোমরা এইখানে থাক। ঘর থেকে বেরিয়ো না। আমি একটু দেখে।
কিন্তু দেখবটা কি? লণ্ঠন হাতে সারা বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজলাম। আওয়াজের উৎস কোথায় ধরতে পারলাম না। এক এক সময় মনে হচ্ছিল যেন চারদিক থেকেই শব্দটা আসছে। এ কি ব্যাপার!
বৈঠকখানায় ফিরে আসবার পথে কান্নাটা থেমে গেল। ঘরে ঢুকে দেখি শচী আঁর রামদুলাল পাথরের মূর্তির মত চৌকিতে পা তুলে বসে আছে। ঝড়ে কাক মরলেও কেরামতি ফকিরের হয় জানেনা তো? আমার হল তাই। আমি লণ্ঠন হাতে বেরুবার একটু পরেই কান্নাটা থেমে যেতে ওদের দুজনের ধারণা হল আমিই তন্ত্রমন্ত্রের প্রভাবে আওয়াজটা বন্ধ করেছি। আমাকে দেখে রামদুলাল বলল-ওঃ, কি ভয়ানক। শব্দ। কি করে থামালেন ঠাকুরমশায়? ভাগ্যিস আপনি এসেছিলেন!
ব্যাপারটা বুঝে চুপ করে রইলাম। ওদের ভুল ভাঙিয়ে লাভ নেই। আমার ওপরে ভরসা করে যতটুকু সান্ত্বনা পায় পাক না।