বললাম—কেন? আপনার এ ব্যাপারে বৈশিষ্ট্যটা কি?
—আছে। তোমাদের নিরাপদ তরঙ্গহীন জীবনে দুশ্চিন্তা এবং দুর্ভাবনা একটা অস্বাভাবিক দুর্ভাবনা একটা স্বাভাবিক ঘটনা বলেই গণ্য করতাম। রাত্তিরে একটা ভয়ানক কিছু ঘটবে জেনেও দুপুরে ভোজ খেতে বাধেনি।
পরপর কয়েকটা চুমুকে চায়ের কাপ শেষ করে নামিয়ে রেখে তারানাথ বহুদিন আগেকার কথা মনে পড়ে যাওয়ার সুরে বলল—ভোজ খাওয়ার কথা উঠলেই আমার রামদুলাল মিত্রের কথা মনে পড়ে যায়। তাদের বাড়ি অতিথি হয়ে কয়েক দিন যা খাওয়াদাওয়া করেছিলাম, তেমন সচরাচর কারও ভাগ্যে জোটে না।
কিশোরী বলল—বেড়াতে গিয়েছিলেন?
-আরে না না, আমার আবার বেড়াতে যাওয়ায় গিয়েছিলাম কাজে। বিপদে পড়ে তারা ডেকে নিয়ে গিয়েছিল। সে অনেক কাণ্ড।
বললাম—গল্পটা হোক বরং, শুনতে মন্দ লাগবে না মনে হচ্ছে।
তারানাথ মনে মনে একটু গুছিয়ে নিয়ে বলতে শুরু করল।
বছর কুড়ি আগেকার কথা। মধুসুন্দরী দেবীর ব্যাপার মিটে গিয়েছে। বাড়িতে বসে ঘোরতর সংসার করছি। এর সঙ্গে হাত দেখি, কবচ দিই, মুখ দেখে ভাগ্যগণনা করি। আয় মন্দ হয় না, আবার খরচও হয়ে যায়। পয়সা জমাতে পারি নি কোন দিন। দেবী বলেই দিয়েছিলেন—অন্নের কষ্ট হবে না, কিন্তু ধনীও হতে পারব না।
একদিন সকালে বৈঠকখানায় বসে আছি, একজন মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক ঘরে ঢুকলেন। কাচায়পাকায় মেশানো চুল, বেশ বলিষ্ঠ ধাচের মাঝারি গড়নের চেহারা। পরনে দামী কাচি ধুতি, পাঞ্জাবিতে সোনার বোতাম। ডান হাতে অনেকগুলো পাথর বসানো আংটি। চেহারায় বড়মানুষীর ছাপ আছে। ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ।
ভদ্রলোক আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন—আপনিই কি তারানাথ জ্যোতিষার্ণব?
—আজ্ঞে হ্যাঁ। কি দরকার বলুন?
ভদ্রলোক এগিয়ে এসে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বললেন—চেহারা দেখেই অবশ্য আন্দাজ করতে পেরেছিলাম।
বললাম—আহা থাক, হয়েছে। বসুন। কি চাই আপনার?
ভদ্রলোক বসে বললেন—আমার নাম রামদুলাল মিত্র। কোলকাতাতেই বড়বাজারের দিকে সামান্য ব্যবসাপাতি আছে। আপনাদের আশীর্বাদে মোটা ভাতকাপড় হয়ে যায়। সম্প্রতি একটা বিপদে পড়ে আপনার কাছে এসেছি। কিন্তু ঠাকুরমশায়, কি বিপদ তা আমি বলব না। শুনেছি আপনি মানুষের মুখ দেখে তার ভূত-ভবিষ্যৎ বলে দিতে পারেন। আপনি বলুন দিকনি, আমার বিপদটা কি? কিছু মনে করবেন না, ঠিক লোকের কাছে এসেছি কি না তা তো আমার জানা দরকার।
ব্যবসাদার লোকের মত কথা বটে। আমি মনে মনে হাসলাম। এ লোক ঘরে ঢোকামাত্র আমি বুঝতে পেরেছি কি বিপদে পড়ে ও এখানে এসেছে। তবে মিথ্যে ভেলকি দেখিয়ে লোককে চমকে দিতে আমার প্রবৃত্তি ছিল না বলে ওকে দিয়েই বলিয়ে নেবার চেষ্টায় ছিলাম। তা বাজিয়ে নিতে চায় যখন তখন আমার আর বলতে আপত্তি কি?
বললাম—বিপদ তো আপনার আপাতত তিনটি দেখতে পাচ্ছি। প্রথমত আপনার ব্যবসা হঠাৎ একটা টাল খেয়েছে, কেমন কি না?
—আজ্ঞে হ্যাঁ, তারপর?
—এটার জন্য ভাবতে হবে না। এখানে বসেই বলে দিচ্ছি। আপনি নীল রঙের গণেশ গড়িয়ে পুজো করুন—আবার ব্যবসার মোড় ফিরবে।
রামদুলাল বললেন—আর?
—আপনার বাস্তুবিঘ্ন আছে দেখতে পাচ্ছি। বসতবাড়ি-সংক্রান্ত কোন গোলযোগে পড়বেন কিংবা পড়েছেন।
রামদুলাল চোখ বড় বড় করে বললেন-ধন্য। শুনেছিলাম, আজ চোখে দেখলাম। কিন্তু তিন নম্বরটা কি?
বললাম—বলবো? ওটা আপনি নিজেই মিটিয়ে নিতে পারবেন, আমার সাহায্য দরকার হবে না। কিছু টাকা এককালীন দিয়ে যাওয়া বন্ধ করুন।
রামদুলাল মাথা নিচু করে লজ্জিত মুখে বললেন—কি আর বলব ঠাকুরমশায়, প্রবৃত্তি বড় বলবান। অপরাধ করে ফেলেছি, এখন প্রায়শ্চিত্ত তো করতেই হবে। পাপ ছাড়ে না বাপকে।
বললাম—অনুতাপ যখন হয়েছে তখন পাপ আর নেই। ঘরে মা-লক্ষ্মী আছেন তো?
—আজ্ঞে তা আছেন।
—তাকে নিয়েই সুখী হতে হবে। মনে মনে তার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেবেন।
—আজ্ঞে যা বলছেন করব। এখন আমার এ বিপদ থেকে উদ্ধার পাবার পথ বলে দিন।
—খুলে বলুন।
রামদুলাল বললেন—ছোটবেলায় বড় কষ্টে মানুষ হয়েছি ঠাকুরমশায়। বাপ-মা অল্প বয়সে মারা গিয়েছিলেন। কুলিগিরি করে, মাথায় মোট বয়ে, একটা-একটা করে পয়সা জমিয়ে ব্যবসা শুরু করি। প্রথম জীবনে থাকার জায়গা ছিল না, কখনও কখনও রাস্তায় শুয়েও রাত কাটিয়েছি। আজও আমার কোলকাতায় কোন বাড়ি নেই। বড় একখানা বাড়ি আস্ত নিয়ে থাকি বটে, কিন্তু সেটা ভাড়া-বাড়ি। বাড়ি কিনতে পারতাম, কিন্তু সত্যি বলতে কি, কোলকাতায় বাড়ি করতে ইচ্ছে যায় না। ছোটবেলায় গ্রামে মানুষ, আর কটা দিন পরে ছেলেদের হাতে ব্যবসা দিয়ে আবার গ্রামে গিয়ে বাস করব ঠিক করেছি। তা গত বছর শেষের দিকে এক দালাল খবর আনল রাজবলহাটের কাছে এক গ্রামে একটা খুব ভাল বাড়ি বিক্রি আছে। নতুন বাড়ি না হলেও সামান্য মেরামত করে নিলে নতুনের মতই দাঁড়া বে। সেখানকার জমিদারদের বাড়ি। জমিদার মারা গিয়েছেন, জমিদারি বিক্রি করে ছেলেরা কোলকাতায় উঠে আসতে চায়। বাড়িও আর রাখবে না, নামমাত্র দামে বেচে দিচ্ছে। দালালের মাধ্যমে দর করে বাড়ি তো কিনলাম ঠাকুরমশায়। অনেক আশার বাড়ি। কিন্তু এখন সে বাড়িতে বাস করা অসম্ভব হয়ে উঠেছে।
বললাম—কেন, কি হয়েছে?
—আজ্ঞে বাড়িটায় অপদেবতার দৃষ্টি আছে। কেনবার পর আমরা সবাই কয়েকটা দিন থাকবার জন্য সেখানে গিয়েছিলাম। প্রথম দিনই আমার স্ত্রী কি দেখে রাত্তিরে ভয়ে চিৎকার করে উঠলেন। জানলার কাছে নাকি ছায়ার মত কি দাঁড়িয়ে ছিল। অথচ দোতলার জানলা, কোন খাজ বা কানিশ নেই। চোর কিম্বা ডাকাত কি বেয়ে উঠবে? পরের দিন সন্ধ্যের দিকে আমার বড় ছেলে শচীদুলাল পায়খানা করতে গিয়েছিল। কিছুক্ষণ বাদে ফিরে এসে বলল—বাবা, বাড়ির বাইরে কে বসে কাঁদছে বলুন তো? মেয়েছেলের গলা মনে হল—