ফিরে এসে মাধব ঘোষকে ডাকলাম। বললাম, দেখ, আজ তোমার আমার দুজনেরই খুব বিপদ। কি বিপদ তা আমি তোমাকে বলব না। তোমার জেনেও কাজ নেই। মোট কথা আজ আর তুমি বা তোমার বাড়ির কেউ বাড়ির চৌহদ্দির বাইরে পা দেবে না। চুপ করে বাড়িতে বসে ভগবানের নাম কর। আর আমাকে এক ঘটি জল এনে দাও তো—
মাধবের মুখ শুকিয়ে আরো ছোট হয়ে গেল। দৌড়ে এক ঘটি জল নিয়ে এল সে। আমি সাধুর দেওয়া গাত্রবন্ধনের মন্ত্র দিয়ে জলটা শোধন করে বাড়ির চারদিকে ঘুরে ছিটিয়ে গণ্ডি কেটে দিলাম।
আমি বুঝতে পেরেছিলাম বিপদ শুধু আমার আর মাধবের। কাপালিক আমাকেও ছাড়বে না। আজ অমাবস্যা, আজই সে আমাদের দুজনকে বেতাল পাঠিয়ে শেষ করবে। অন্যরা হয়তো নিরাপদ! তবু সাবধানের মার নেই জেনে সারাবাড়ির চারদিকেই গণ্ডি দিয়ে দিলাম।
রাত্তিরে খাওয়া হলে আমি মাধবকে ডেকে বললাম, তুমি আমি আজ এক ঘরে থাকব। বাড়ির সবাই শুয়েছে?
—আজ্ঞে ঠাকুরমশাই।
—বেশ, এস আমার সঙ্গে।
ঘরে গিয়ে আমি মাধবকে বললাম, ওই ঘটি থেকে খানিকটা জল ঢাল মাটিতে। এই যে, খাটের পায়ার কাছে—এইখানটায় ঢাল–আচ্ছা, এবার ডান পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে ওই জল থেকে রেখা টেনে খাটের চারদিকে একটা জলের গণ্ডি কাট। নাও, শুরু কর, আমি তোমার সঙ্গে মন্ত্র পড়তে পড়তে ঘুরছি। তুমি গৃহস্বামী, তোমাকেই করতে হবে। নইলে আমি করে দিতাম।
সেই গণ্ডির ভেতরে খাটে উঠে আমরা দুজন বসে রইলাম। সে কি ভয়ঙ্কর রাত। আমার বুকের ভেতরে এই বিচিত্র বিপদের ঘণ্টা বেজে চলেছে। কি যেন ঘটবে, কে যেন আসছে। আমার পাশে চুপ করে বসে মাধব।
ঠিক মাঝরাত পেরিয়ে যাবার পর হঠাৎ যেন একঝলক হাওয়ায় বাইরের আমবাগান কেঁপে উঠল। ঝড়ের সময় নয়, কিছু নয়—হাওয়া এল কোথা থেকে?
ক্রমে সেই হাওয়া বেড়ে রীতিমত ঝড়ে পরিণত হল। সমস্ত আমবাগান যেন ভেঙে পড়বে, বাড়ির জানলা-দরজা দড়াম দড়াম করে বন্ধ হতে আর খুলতে লাগল। বাড়ির ভেতর মেয়েরা শব্দ করে কেঁদে উঠল—আমি চেচিয়ে বললাম, কেউ বাইরে আসবেন না। সব ভেতরে বসে থাকুন।
ঝড়ের শব্দের মধ্যে কার যেন বীভৎস হুঙ্কার—বিকৃত জাস্তব গলায় কে যেন অমানুষিক হুঙ্কার করছে। কে যেন ঝড়ের ছদ্মবেশে প্রাণপণ চেষ্টা করছে বাড়িতে ঢোকবার, বার বার অদৃশ্য কিসে বাধা পেয়ে ফিরে যাচ্ছে।
খানিকক্ষণ এরকম চলার পর হঠাৎ ঝড়টা যেন এক মুহুর্তে থেমে গেল। আবার শাস্ত আমবাগান, মৃদু হাওয়ায় বাড়ির কলাগাছের পাতা নড়ছে। যে বাড়িতে ঢোকবার চেষ্টা করছিল, সে যেন উদ্দেশ্য সফল হবে না বুঝে ফিরে গিয়েছে। আমার বুকের ভেতরে বিপদের ঘণ্টাও হঠাৎ থেমে গেল।
মাধব ঘোষ আতঙ্কিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। আমি বললাম—আর ভয় নেই, বেঁচে গেলাম বোধ হয়।
সেদিন রাত্তিরটা আমরা খাটেই বসে রইলাম। পরের দিন সকালেই খবর পেলাম মাধবের মেয়ের জ্বর নেমে গিয়েছে। আমি সকালেই বিদায় চেয়েছিলাম, মাধব ঘোষ কিছুতেই ছাড়ল না। খালি বলে—আপনার দয়াতেই রক্ষা পেলাম। বেঁধে রাখতে পারব না জানি, তবু এ বেলাটা থেকে যেতেই হবে।
থেকে ভালই করেছিলাম। নইলে ঘটনার শেষটুকু জানতে পারতাম না।
বিকেলে মাধবের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে প্রায় মাইলখানেক চলে এসেছি, দেখি ঘোড়ায় চড়ে এক দারোগাবাবু কোথায় যেন চলেছেন, পেছনে দুজন পাগড়ীওয়ালা সেপাই। আমার কাছ দিয়ে যখন তারা যাচ্ছেন, কি মনে হতে একজন সেপাইকে জিজ্ঞাসা করলাম, কোথায় চলেছ বাপু?
সেপাইটা বলল, সামনে বিরামখালিতে একটি শ্মশান আছে, জানেন? সেই শ্মশানে এক কাপালিক থাকত। সে খুন হয়েছে।
ধরা গলায় বললাম, খুন হয়েছে বোঝা গেল কি করে?
—মাথাটা নাকি একেবারে মুচড়ে উলটোদিকে ঘুরিয়ে দিয়েছে। অনেকে মিলে করেছে আর কি। একজনের কাজ না।
আমি তখন সব বুঝতে পেরেছি। কাপালিকই তো বলেছিল বেতাল বাধা পেলে ফিরে গিয়ে যে জাগিয়েছে তাকেই আক্রমণ করে। কি ভয়ঙ্কর মৃত্যু!
একবার তাদের সঙ্গে গিয়ে মৃতদেহটা দেখে আসবার ইচ্ছে হয়েছিল। পরে সে ইচ্ছে দমন করি। মনে মনে আমাদের গায়ে দেখা সৌম্য সাধুকে প্রণাম জানিয়ে আবার রওনা দিলাম।
গল্প শেষ করে তারানাথ বললে, কি রকম শুনলে?
আমরা বললাম, ভালই।
পথে বেরিয়ে কিশোরীকে বললাম, বিশ্বাস হল?
সে-কথার জবাব না দিয়ে কিশোরী হেসে বললে, দিনটা তো ভাল কাটল?
০২. তারানাথের বৈঠকখানার আড্ডা জমে উঠেছে
বিকেল। তারানাথের বৈঠকখানার আড্ডা জমে উঠেছে। রোজ রোজ তারানাথের স্কন্ধে কণ্টকী ফল ভগ্ন করা উচিত নয় ভেবে আমি আর কিশোরী মোড়ের তেলেভাজার দোকান থেকে গরম গরম বেগুনী আর ফুলুর কিনে নিয়ে এসেছিলাম। এখন শুধু শালপাতা কটা পড়ে আছে। ভেতর থেকে দ্বিতীয়বার চা-ও এসে উপস্থিত। তৃপ্তির সেঁকুর তুলে তারানাথ বলল—নাঃ, উড়েগুলো বেশ ভাল তেলেভাজা করে, বুঝলে?
কিশোরী বলল—সব কিছুর স্বাদ নির্ভর করে মনের অবস্থার ওপরে। আজ এখন আপনার কোনো কাজ নেই, বেশ নিশ্চিন্দি আড্ডার মেজাজ। এখন বাসি তেলেভাজা পচা বেসনের ঠাণ্ডা ফুলুরিও ভাল লাগবে। আবার মাথায় দুশ্চিন্তা থাকলে দেরাদুন। চালের বিরিয়ানিও মুখে রুচবে না। নয়?
তারানাথ মৃদু হেসে চায়ে চুমুক দিয়ে বলল—কথাটা তোমাদের পক্ষে সত্য হলেও আমার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ খাটে না বোধ হয়।