কোনোরকমে বাড়ি ফিরে এসে শুয়ে পড়লাম। পরদিন সকালে মেঘ কেটে সূর্য উঠল পাঁচদিন বাদে। ঝকঝকে রোদুরে ভেসে যাওয়া পৃথিবীর রূপ দেখে আমার নিজেরই সন্দেহ হতে লাগল—সত্যিই কি কাল রাত্তিরে কিছু ঘটেছিল? বাড়ির কাউকে কিছু জানালাম না। অনর্থক তাদের চিন্তা বাড়িয়ে লাভ কি?
মা সুস্থ হয়ে ওঠার মাসখানেক পরে আবার বাড়ি ছাড়লাম। একটানা গৃহবাস ঈশ্বর আমার কপালে লেখেন নি। ঘুরতে ঘুরতে এক সন্ধ্যায় খামারবেড়িয়া নামে এক গ্রামে গিয়ে পড়লাম। দেখি গ্রামের একধারে ঝুরিনামা বটগাছের নিচে একজন জটাধারী সাধু ধুনি জ্বালিয়ে বসে আছেন। ভাবলাম ভালই হল, আজ রাত্তিরটা অন্তত এর সঙ্গে কাটানো যাবে। গুটি গুটি ধুনির এপারে গিয়ে বসলাম। প্রত্যেক গ্রামেই কিছু লোক থাকে যারা সাধু-সন্ন্যাসী দেখলে ওষুধ-বিষুধ আর মাদুলির জন্য ভিড় করে। এখানেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। জনাকয়েক লোক করুণমুখে তাদের দুঃখদুর্দশার কথা সাধুকে জানাচ্ছে। ক্রমে তারা বিদায় নিয়ে চলে গেলে সাধুবাবা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন—তারপর? তোমার কি চাই?
সবিনয়ে জানালাম, আমার কিছু চাই না।
—তবে আর কি, যাও, বাড়ি যাও—
দু-এক কথায় বুঝিয়ে দিলাম আমার বাড়ি এখানে নয়, আমি পথে পথে বেড়িয়ে বেড়াচ্ছি, আপাতত রাতটা এখানে কাটাতে চাই।
সাধু আর কোনো ব্যক্তিগত প্রশ্ন করলেন না, বললেন—থাকে।
একটু পরে নিজের ঝুলি থেকে একটা পাকা কলা আর একটা পেয়ারা বের করে আমাকে দিয়ে বললেন—খাও, আর কিছু আমার কাছে নেই।
—আপনি খাবেন না?
–আমি রাত্তিরে কিছু খাই না।
দু-একটা কথা বলতে বলতে আলাপ জমে উঠল। দেখলাম সাধুজী স্বল্পভাষী হলেও বদমেজাজী নন। একসময় আমাকে বললেন—এখানে ধুনি জেলে আজ ভুল কাজ করেছি, বুঝলে? দু-একদিন থাকব ভেবেছিলাম, কিন্তু কাল চলে যেতে হবে।
—আজ্ঞে, কেন?
ওপরদিকে আঙুল তুলে সাধুজী বললেন—এই গাছে অনেক পাখির বাসা রয়েছে, ধুনির গরম হলকা আর ধোঁয়ায় তারা আজ কেউ বাসায় ফিরতে পারেনি। ওই দেখ, ওদিকে একটা গাছের ডালে বসে কিচমিচ্ করছে। কাউকে গৃহহীন করা মহাপাপ। ইতর প্রাণীদেরও আত্মা আছে, তাদের মনে দুঃখ দিলে সাধনার ফল ক্ষয় হয়ে যায়—
বললাম যদি কিছু মনে না করেন, একটা কথা জিজ্ঞেস করব?
–কি?
—আপনি কোন মার্গের সাধক?
—কেন বল তো?
—আপনার কথা শুনে আমার খুব ভাল লাগছে। আমি অনেক সাধুসঙ্গ করেছি, বেশির ভাগ সাধকেরা অস্তরে মহৎ হলেও বড় কটুভাষী, অপরের দুঃখ সম্বন্ধে উদাসীন। আপনার মত কথা বলতে শুনিনি কাউকে।
সাধু মৃদু হেসে বললেন—কোনো মার্গেরই নয়। আমার দীক্ষাই হয়নি।
অবাক হয়ে বললাম—সে কি! তাহলে?
–তাহলে আর কি? ভগবানের স্বরূপ জানতে ইচ্ছে করে, তাই ঘুরে বেড়াই, তার সৃষ্টির বিচিত্র রূপের মধ্যে তাঁকে খুঁজতে চেষ্টা করি। ভগবানকে ডাকব, তার আবার মার্গ কি? দীক্ষা কি?
সাধুজীর ওপর শ্রদ্ধা হল। আবছা অনুভব করতে পারলাম—অনেক বড় সাধক ইনি। সারারাত ধরে কত গল্প করলেন, ধর্মের বিভিন্ন দিক সম্বন্ধে গভীর জ্ঞানের পরিচয় দিলেন। সঙ্কীর্ণতা নেই এতটুকু। সব মতের প্রতিই সমান শ্রদ্ধা।
তাকে প্রশ্ন করলাম—আপনি যে ভগবানকে ডাকেন, তার কোন রূপ কল্পনা করেন। ধ্যানের সময়?
—কোনো রূপই নয়। মনকে কেন্দ্রীভূত করতে পারলে ঈশ্বরের রূপকল্পনার প্রয়োজন হয় না। দুরকম শক্তি মহাবিশ্বে ক্রিয়াশীল। শুভশক্তি, আর ঈশ্বরবিরোধী অশুভশক্তি। বিশ্বের সৃষ্টির সময়েই এই দুই শক্তির জন্ম। ঈশ্বরবিরোধী শক্তির ক্ষমতা কিন্তু কম নয়, বৌদ্ধধর্মে একেই মার’ হিসেবে কল্পনা করা হয়েছে। কালভৈরবের মাধ্যমে জগদীশ্বর এর দমন করেন। সর্বদা এই দুই শক্তির লড়াই চলেছে। তোমার চারদিকে তার প্রকাশ তো দেখতেই পাচ্ছ—
বললাম—-কালভৈরব কে? তিনি শুভশক্তির প্রয়োগকর্তা। দক্ষিণকালিকাতন্ত্রে তার রূপ কল্পনা করা হয়েছে এইভাবে—মহাবলশালী পুরুষ, ঘোর কৃষ্ণবর্ণ, নগ্নগাত্র, রিপুতাড়ন তার প্রধান কর্ম। শূকরের ছদ্মবেশে কাম-ক্রোধ-হিংসা ইত্যাদি রিপুগণ তার বশবর্তী হয়ে সর্বদা তার সঙ্গে ঘোরে। নিজের বুকের পাঁজরের একখানা হাড় দিয়ে তিনি তাদের শাসন করেন।
আমি তখন উত্তেজনায় সটান খাড়া হয়ে বসেছি। এ বর্ণনা তো কইখালির মাঠে শৈশবে দেখা সেই মানুষটির সঙ্গে হুবহু মিলে যাচ্ছে। বললাম—তারপর?
—আর কি? কালভৈরবই অনিবার্য ধ্বংসের হাত থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করছেন। ঈশ্বরের সাক্ষাৎ শিষ্য তিনি। আমি সেই ভগবানেরই আরাধনা করি।
আমার গলা তখন আবেগে বুজে এসেছে। স্বয়ং কালভৈরব সেদিন রাত্তিরে আমাকে স্বয়ং এসে রক্ষা করেছেন। শৈশবে তার অপার করুণার স্পর্শ দিয়েছেন।
একটু চুপ করে থেকে তারানাথ বলল—কিন্তু সে তুলনায় জীবনে কিছুই করতে পারলাম না। কতগুলো তুচ্ছ সিদ্ধাই পেয়েছিলাম, কিছু টাকাকড়ি-বড় কিছুই হল না। এ জন্ম এমনই গেল। দেখি, যদি পরজন্ম বলে কিছু থাকে—অন্তত এবারের ভুলগুলো আর করব না—
তারপর আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল—আজকের গল্প এইখানেই শেষ। কিন্তু ভয় পেয়ো না, বলবার মত গল্প আমার ঝুলিতে আরো অনেক রয়েছে সময়মত বলা যাবে। আজ থামি তাহলে, কেমন?
(সমাপ্ত)