হঠাৎ দিকদিগন্ত উদ্ভাসিত করে একবার বিদ্যুৎ চমকাল।
সামনের দিকে তাকিয়েছিলাম, অন্ধকারে হাটবার সময় মানুষ যেমন মুখটা একটু তুলে রাখে, বিদ্যুতের উজ্জ্বল আলোয় স্পষ্ট দেখলাম উলটোদিক থেকে একজন মানুষ আমার দিকে এগিয়ে আসছে। বিদ্যুতের আলো একমুহূর্তের বেশি ছিল না, কিন্তু আলো নিভে যাবার পরেও মনে মনে চিন্তা করে কোথায় কি দেখেছি, কতটা দেখেছি বোঝা যায়। যে লোকটা আমার দিকে এগিয়ে আসছে তার হাঁটার ভঙ্গিতে কোন জড়তা নেই, অন্ধকারেও যেন সে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে। তার গা খালি, কালো রঙ-পরনে একটা নেংটিমত কাপড়ের ফালি। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা ও লোকটাকে আমি চিনি! খুব পরিচিত সে, এই—কিছুদিনের ভেতরেই কোথায় যেন দেখেছি। কোথায়? কোথায়?
অকস্মাৎ আমি বুঝতে পারলাম, এবং সঙ্গে সঙ্গে অনুভব করলাম আমি ভয়ানক বিপদগ্রস্ত। জীবিত অবস্থায় এ মাঠ থেকে বেরুতে পারব কিনা তার নিশ্চয়তা নেই। কারণ—
যে মানুষটির মৃতদেহের ওপর বসে ছ-মাস আগে আমি সাধনা করে এসেছি তার শব এগিয়ে আসছে আমার দিকে, বৃষ্টিধারার মধ্যে দিয়ে।
গুরুর কথাই ফলে গেল। সময়মত সাধনা শেষ করতে পারিনি, এবার সেই শৈথিল্যের মূল্য বুঝে নিতে আসছে ওই মূর্তি।
যতদূর সম্ভব শব্দ করা থেকে বাঁচিয়ে সাবধানে জলে পা ফেলে ডানদিকে সরে যেতে লাগলাম—একটু ঘুরপথে হলেও যদি ওই জীবন্ত বিভীষিকার হাত এড়িয়ে গ্রামের পথে পা দিতে পারি। একবার বাড়ি পৌঁছতে পারলে আর ভয় নেই। সেখানে প্রতিষ্ঠিত গৃহদেবতা আছেন, সেখানে এই শরীরী আতঙ্ক প্রবেশ করতে পারবে না।
অনেকখানি সরে এসেছি এমন সময় আবার চমকে উঠল বিদ্যুৎ। চকিত মুহূর্তের মধ্যেই দেখতে পেলাম চলন্ত অপচ্ছায়াও তার গতিপথ বদলে সোজা আমার দিকে আসছে।
আমারই ভুল। অন্ধকারে ওই ভয়ঙ্করের দৃষ্টি বাধা পায় না। এভাবে ওকে ফাকি দেবার চেষ্টা বৃথা। আদিম জড়বিশ্বের বুদ্ধিহীন, চেতনাহীন অন্ধশক্তির দ্বারা চালিত হয়ে একটা বিকৃত মানবদেহ অমোঘগতিতে আমার নিকটবর্তী হচ্ছে। কোনোক্রমে বাড়ি ফিরতে পারলে কয়েকটা গৃঢ় প্রক্রিয়ার দ্বারা একে আমি ঠেকাতে পারি, কিন্তু এই মাঠে দাঁড়িয়ে তা সম্ভব নয়।
শেষ চেষ্টা করার জন্য আমি হাতের জিনিসপত্র ফেলে দিয়ে মাঠের দূর প্রান্তের দিকে প্রাণপণে দৌড়তে লাগলাম। পারব কি গ্রামের পথে পৌঁছতে? সে পথে একটু এগিয়ে হাক দিলে গ্রামের শেষে কোনো বাড়ি থেকে হয়ত শুনতে পাওয়া যাবে।
হঠাৎ অন্ধকারে উঁচুমত একটা কিসের সঙ্গে হোচট খেয়ে ঠিকরে পড়লাম জলে। প্রথমেই বলেছি মাঠের মধ্যে কয়েক জায়গায় উঁচু ডাঙা দ্বীপের মত জেগে ছিল, তারই একটাতে ঠোক্কর লেগে পড়েছি বুঝতে পারলাম। একটা মাটির ঢেলা বা ইটের টুকরোতে ডান হাটু পড়েছিল, দারুণ যন্ত্রণায় মাথার ভেতর অবধি ঝনঝন করে। উঠল। হাটু আর সোজা করতে পারছি না।
বেশ কিছুক্ষণ আর উঠতে পারব না বুঝতে পারলাম। এতক্ষণ নিজের পায়ের শব্দে টের পাইনি, এবার শুনতে পেলাম ছপ ছপ করে জলের ওপর দিয়ে ভারী পায়ের আওয়াজ ক্রমেই এগিয়ে আসছে কাছে। এল, এল, ওই এল!
অতিরিক্ত ভয়ে, আতঙ্কে আর আসন্ন ভয়াবহ মৃত্যুর উপলব্ধিতে অকস্মাৎ আমার মন থেকে সবরকম অনুভূতি লুপ্ত হয়ে গেল। হাঁটু চেপে ধরে চিৎ হয়ে শুয়ে আছি, মুখের ওপর বিরবির করে বৃষ্টি পড়ছে, কানে ভেসে আসছে দূরাগত মেঘগর্জন-কিন্তু হাঁটুতে প্রবল যন্ত্রণা ছাড়া পৃথিবীর আর সব বাস্তবতা আমার কাছে অর্থহীন হয়ে গিয়েছে।
এমন সময় আমার চারদিকে জলের ওপর অনেকগুলো পায়ের শব্দ জেগে উঠল। অগুনতি পা দ্রুত জলে পড়ছে, কারা যেন ছুটে যাচ্ছে এদিকে সেদিকে। আশ্চর্য। কাদের পায়ের শব্দ এ? এখানে আসতে হলে তো জল পেরিয়ে জানান দিয়ে আসতে হবে, কিন্তু এই পদশব্দ যেন অকস্মাৎ জলের বুকেই জন্ম নিল–শুন্য থেকে জেগে উঠল হঠাৎ।
তড়বড় করে একদল ঘোড়া যেন ছুটে যাচ্ছে সামনে-পেছনে। কি ঘটছে কিছুই বুঝতে পারছি না। বিদ্যুতও চমকাচ্ছে না বেশ কিছুক্ষণ।
এবং তারপরেই আমার চারদিকে একপাল শুয়োরের ঘোৎ ঘোৎ শব্দ শুনতে পেলাম!
এই দুর্যোগে কইখালির মাঠে শুয়োর কোথা থেকে এল? তাও একটা দুটো নয়, পায়ের আওয়াজে বুঝতে পারছি পনেরো কুড়িটা প্রাণী অন্তত ছুটোছুটি করছে।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আমার মনে পড়ে গেল শৈশবে দেখা সেই অদ্ভুত মানুষটিকে, সরু হাড়ের দণ্ড দিয়ে যিনি শূকররূপী হিংস্র প্রবৃত্তিগুলিকে শাসন করেন। তবে কি তিনিই—
আমার খুব কাছে এসে কে দাঁড়িয়েছে। তাকে আমি দেখতে পাচ্ছি না, কিন্তু সে আমাকে দেখতে পাচ্ছে। আমার মনে আর ভয় নেই, পরিবেশ থেকে মুছে গিয়েছে অমঙ্গলের অনুভূতি। বরং কার অদৃশ্য উপস্থিতিজনিত পবিত্রতা অনুভব করছি সমস্ত অস্তিত্বে।
কে যেন ভালবেসে হাত রাখল—না, আমার হাতে নয়, শরীরের কোথাও নয়—সে হাত রেখেছে আমার বুকের ঠিক মধ্যেটায়।
তারপরই বুঝলাম মাঠে আমি একা, সে উপস্থিতি আসন্ন মৃত্যুর হাত থেকে আমাকে রক্ষা করে ফিরে গিয়েছে স্বস্থানে। এতক্ষণ বাদে এবার বিদ্যুৎ চমকাল, আকাশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে চিরে যাওয়া আলোয় ভাল করে তাকিয়ে দেখলাম কোথাও আর কেউ নেই। সে অপচ্ছায়াও নয়—আমার ত্রাণকর্তাও নয়।
রাত বোধহয় আড়াইটে। বৃষ্টি ঝরছে তো ঝরছেই।