কৈশোরে মাছ ধরবার খুব নেশা ছিল। শুধু বড়শি দিয়ে নয়, পোলো, হাত-জাল আর কোচ দিয়েও বহু মাছ ধরেছি। মাছ খাব বলে মাছ ধরা নয়, আসলে এর তোড়জোড় আর মজাটাই বড় কথা। বনমালীর বর্ণনা শুনে হঠাৎ পুরনো নেশাটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। এমন ঘনঘোর বর্ষা দিনরাত্রির ব্যাঙ ডাকছে খালেবিলে—এই তো মাছ ধরার উপযুক্ত সময়। বনমালীকে ডেকে বললাম—বনমালীদা, তোমার কাছে একটা পোলো হবে?
—পোলো? মাছ ধরবে নাকি?
—হ্যাঁ। অনেকদিন অভ্যেস নেই অবিশ্যি, দেখি তবু–
-–আছে বোধহয় একটা। ওবেলা এনে দেব এখন।
বিকেলে বনমালী পোলো এনে দিল। পোলো জানো তোমরা? বেত বা কঞ্চির চটা দিয়ে তৈরি একটা গোল খাঁচামত জিনিস, ফুটতিনেক উঁচু। ওপরদিকে সরু মুখ, সেখান দিয়ে হাত গলিয়ে মাছ বের করতে হয়। তলার দিকের ঘের বড়। মাছ দেখতে পেলেই ঝপ করে পোলো দিয়ে চেপে ধরলে আর পালাতে পারে না। ছিপ না নিয়ে পোলো নেবার কারণ হল—আমি রাত্তিরে মাছ ধরব স্থির করে ফেলেছি। আলো নিয়ে মাছ ধরা ভারি মজার। বিশেষ করে সে সময়ে বিরক্ত করার কেউ থাকে না, পাশে দাঁড়িয়ে পরামর্শ দেয় না, কটা মাছ পেয়েছি জিজ্ঞাসা করে না। রাত্তিরেই ভাল।
পোলো দিয়ে মাছ ধরতে হলে পুকুর বা বিলে সম্ভব নয়, অগভীর জলাশয় প্রয়োজন। সন্ধ্যের একটু আগে গিয়ে কইখালির মাঠের অবস্থা দেখে এলাম। সমস্ত মাঠটায় পায়ের গোছ ডুবে যায় এমন জল। মাঝে মাঝে সামান্য উঁচু জমি এখানেওখানে দ্বীপের মত জেগে আছে। একেবারে আদর্শ জায়গা।
খাওয়া-দাওয়া সেরে রাত এগারোটা নাগাদ লণ্ঠন আর পোলো নিয়ে বেরুলাম। বনমালী সঙ্গে আসতে চেয়েছিল, আমি রাজি হইনি। ওই যে বললাম, মাছ ধরার পরিবেশটাই আসল। সঙ্গে লোক থাকলে বকবক করবে, নানান কথা বলবে—নাঃ, সে সুবিধে হবে না।
কিন্তু বনমালীকে সঙ্গে নিলেই ভাল করতাম। তখনও জানিনা কি ঘটতে চলেছে সেদিন রাত্তিরে।
সন্ধ্যে থেকে বৃষ্টিটা একটু ধরেছে, আজ পাচদিন পর এই প্রথম একটু ক্ষান্তি। কিন্তু সমস্ত আকাশ কালো মেঘে ঢেকে রয়েছে, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে একটু বাদে বাদেই। যে কোন সময়ে আবার কেঁপে জল আসতে পারে। খুড়তুতো ভাইয়ের কাছ থেকে তার বাঁশের হাতলওয়ালা ছাতাখানা চেয়ে এনেছি, সেটা বগলে রয়েছে। ভাজ করা। ছাতার ভেতরে আছে মুগার সুতো দিয়ে বোনা জালের থলে। মাছ পেলে তাতে রাখা হবে। আয়োজন সব ঠিক, এবার দেখা যাক কি রকম কি হয়। ভোর রাত অবধি চেষ্টা তো চালিয়ে যাব।
মাঠে পা দিয়েই বুঝলাম বনমালী মিথ্যে খবর দেয়নি। খালবিল ভেসে গিয়ে প্রচুর মাছ চলে এসেছে কইখালির মাঠে। কিন্তু মাছ থাকা আর মাছ ধরা এক ব্যাপার নয়। তুমি পোলো হাতে এগিয়ে গিয়ে ঝুপ করে চেপে ধরবে বলে মাছ এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকবে তা তো হয় না। জলের জীব—বহু কৌশল করে তবে এদের ধরতে হয়। কৌশল আমার অজানা নেই, ছোটবেলা থেকে মাছ ধরে আসছি। যেমন ধর, শোল বা ল্যাটা মাছ লণ্ঠন উঁচু করে ধরে নাড়ালে আলোয় আকৃষ্ট হয়ে কাছে আসে। কইমাছ আবার আলোটালো কিছুই খেয়াল করে না, ঝাকবেঁধে একদিকে চলেছে তো চলেছেই। এদের ধরা সোজা। শিং আর মাগুর খুব চালাক মাছ, মানুষ বা অন্য কিছুর সাড়া পেলেই আর সে তল্লাটে থাকে না, শো শো করে পালায়—এরা ছোটেও খুব জোরে, জলের মধ্যে দৌড়ে নাগাল পাওয়া যায় না। কিন্তু মজা হচ্ছে, শিং-মাগুর ছোটে একদম সোজা, কোনদিকে গেল খেয়াল করলে একটু পরে পেছন পেছন সেখানে গিয়ে হাজির হওয়া যায়। সচরাচর এরা তাড়া খেয়ে আলের ধারে বা গাছের শেকড়ের কাছে গিয়ে আশ্রয় নেয়, খোলা জায়গায় থাকে না। অমন জায়গায় পোলো বসানো মুশকিল। তখন পা দিয়ে জলে শব্দ করতে হয়, ভয় পেয়ে মাছ আবার দৌড় দেবার উদ্যোগ করলেই তাড়াতাড়ি পোলো বসিয়ে দিতে হয়। যাক গে, কথায় কথায় অন্য প্রসঙ্গে চলে এসেছি, আসল কথাটা বলি।
রাত দেড়টার মধ্যে অনেক মাছ ধরে ফেললাম। মুগার সুতো দিয়ে তৈরি ব্যাগ এত ভারী হয়ে উঠেছে যে, শক্ত সরু সুতো হাতে কেটে বসে যাচ্ছে। এদিকে আবার মেঘ ডাকতে শুরু করেছে, গা শিরশির করা বাদলার হাওয়া দিচ্ছে—বৃষ্টি ফের এল বলে। এবার বাড়ি চলে যাওয়াই ভাল।
অনেকক্ষণ থেকেই মনের ভেতরে কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছিল, কি অস্বস্তি সেটা আমি ঠিক বলে বোঝাতে পারব না। কোন অমঙ্গল আসবার আগে থেকে আমি টের পাই, এ কথা আগেই বলেছি। এতক্ষণ মনের একেবারে তলায় কোণের দিকে কোথাও একটা বিপদের পূর্বাভাস খচ খচ্ করছিল, মাছ ধরার আনন্দ আর উত্তেজনায় খেয়াল করিনি। এবারে পরিপূর্ণ সম্বিত ফিরে পেয়ে চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম ঘনবর্ষার মধ্যরাত্রে গ্রামের বাইরে নির্জন জলভরা মাঠে একা দাঁড়িয়ে আছি। একটা শেয়াল পর্যন্ত এই দুর্যোগে আশ্রয় ছেড়ে বাইরে বের হয়নি। তেমন কিছু ঘটলে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করলেও সাহায্যের জন্য কেউ এগিয়ে আসবে না। নাঃ, বনমালীকে সঙ্গে আনাই উচিত ছিল। এই জলকাদা ভেঙে বাড়ি পৌঁছতেও অন্তত আধঘণ্টা সময় লাগবে। তার মধ্যে আবার বৃষ্টি এসে গেলেই তো হয়েছে।
ভাবতে ভাবতেই ঝিরঝির করে বৃষ্টি নামল। তাড়াতাড়ি ছাতা খুলতে যাচ্ছি, কেমন করে যেন হাত ফসকে লণ্ঠনটা জলে পড়ে নিভে গেল।
চারদিকে নিচ্ছিদ্র অন্ধকার।
কিছুক্ষণ হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। আলো থাকলে বুকে বেশ সাহস থাকে। তাছাড়া আমাদের তন্ত্রশাস্ত্রে বলে আগুন হচ্ছে পবিত্রকারী শুভশক্তি, কোন অশিব উপস্থিতি আগুনের সান্নিধ্যে আসতে পারে না। এইজন্য সাধকদের আসনে সবসময় ধুনি জ্বালিয়ে রাখা নিয়ম। কিন্তু দাঁড়িয়ে থেকে তো লাভ নেই, বরং আন্দাজে আন্দাজে চলতে শুরু করাই ভাল। মাছ ধরতে ধরতে মাঠের একেবারে অপর প্রান্তে চলে গিয়েছিলাম। এবার মাঠ পার হয়ে সেই চট্রকাগাছটার পাশ দিয়ে গ্রামের পথে ঢুকতে হবে। মাথায় ছাতি ধরে মাছভর্তি থলে আর নেভা লণ্ঠন হাতে চট্ৰকাগাছটা আন্দাজ করে হাটতে শুরু করলাম।