—এমন কোন উচ্চমাগের মুক্ত আত্মা যার নাম মুখে উচ্চারণ করার যোগ্যতা আমার নেই। সবরকম সাধনা ও সিদ্ধির উর্ধ্বে চলে গিয়েছেন এমন কেউ। ইতি তোমাকে অনেক বিপদ থেকে রক্ষা করবেন।
আমি ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম—কবে এর দেখা পাব?
শান্তকষ্ঠে গুরু বললেন—এর দেখা তুমি পেয়েছ।
—সে কি কবে?
—তা জানি না। তবে মহাগুরুর সান্নিধ্য পেলে দেহে ও মনে যে যে লক্ষণ ফুটে ওঠে, তা তোমার রয়েছে।
—আমি দেখা পেলাম আর আমিই জানতে পারলাম না?
গুরু বললেন—তেমন তো হতেই পারে। এসব সাধকদের কোন ভেকও নেই, ভড়ংও নেই। নিতান্ত সাধারণ মানুষের মত বেড়ান, দেখলেও হয়ত চিনতে পারবে না।
হঠাৎ আমার ছোটবেলায় দেখা সেই অদ্ভুত মানুষটিকে মনে পড়ে গেল। রোদ ঝিমঝিম করা কইখালির মাঠ, সেই শুয়োরের দল, আমার হারানো শৈশব। তিনিই কি আমার জীবনের অজানা মহাপুরুষ?
তরাই অঞ্চলে কোথায় তন্ত্রসাধকদের এক গোপন মিলনসভা হবে খবর পেয়ে গুরু সেখানে রওনা হয়ে গেলেন, আমি আর সঙ্গে গেলাম না। এবার কিছুদিন একা থাকব ঠিক করলাম। পথে পথে ঘুরি, বেশির ভাগই শ্মশানে-মশানে রাত কটাই, কচিৎ কখনও কোন গৃহস্থবাড়িতে আশ্রয় নিই। একদিন এক রেল স্টেশনের প্লাটফর্মে বসে আছি, আমার ট্রেন আসতে ঘণ্টাখানেক দেরি। সেটা জংশন স্টেশন, লুপ লাইনে যেতে হলে ওখান থেকে গাড়ি বদল করতে হয়।
প্রচণ্ড বৃষ্টি নেমেছে সকাল থেকে, আকাশ কালো হয়ে রয়েছে মেঘে। ঝুপকূপ করে বৃষ্টির আর যেন বিরাম নেই।
দু-পয়সার বিড়ি কিনব বলে স্টেশনের দোকানটার দিকে এগুচ্ছি, হঠাৎ পেছন থেকে কে যেন ডাকল—আরে, তারানাথ না?
থমকে দাঁড়ালাম। এমন জায়গায় আমার নাম ধরে কে ডাকে? এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখি ওজন করার লোহার কলের পাশে কয়েকটা চটের বস্তার আড়ালে বেঞ্চির ওপর বসে আছে আমাদের গ্রামের ভূপতি শিকদারের ছেলে রমাপতি। ছোটবেলায় এই রমাপতিই বোধ হয় গ্রামে আমার একমাত্র বন্ধু ছিল। কতদিন ওদের বাগান থেকে দুপুরে কাচা পেপে ছিড়ে এনে নুন দিয়ে খেয়েছি। গ্রামের পুরনো বন্ধুকে। দেখে হাসিমুখে এগিয়ে গেলাম, রমাপতিও উঠে এসে আমার হাত ধরে বলল—উঃ, কতদিন পরে দেখা! এখানে কি করছিস রে? তোর গেরুয়া কই?
হেসে বললাম—আমি কি সন্ন্যাসী হয়েছি নাকি, যে গেরুয়া পরে ঘুরব?
-সন্ন্যাসী হোস নি? তবে যে সবাই বলে তুই সাধু হয়ে চলে গিয়েছিস?
-সংস্কৃতে সাধু মানে ভাল লোক, সেটা হবার চেষ্টা করছি বটে—তবে ভেকধারী সন্ন্যাসী হইনি। তুই এখানে কেন?
—আমার শ্বশুড়বাড়ি এখান থেকে ট্রেনে বদল করে যেতে হয়। বৌ সেখানে আছে, আনতে যাচ্ছি। আয় ওই দোকানটায় চা খাবি?
পুরনো বন্ধুর অকৃত্রিম আগ্রহে রমাপতি আমার হাত ধরে টেনে চায়ের দোকানে গিয়ে চা আর কেকের অর্ডার দিল। পকেট থেকে নতুন মেপোল সিগারেটের প্যাকেট বের করে আমাকে একটা দিয়ে বলল—ধরা। তারপর তুই কোথায় যাচ্ছিস বললি না তো?
—বিশেষ কোথাও না। বাড়ি ছাড়ার পরে এইরকমই ঘুরে ঘুরে বেড়াই, একজায়গায় থাকি না বেশিদিন–
-–কেন বল দিকি? এতে লাভ কি?
—তা তো তোকে বোঝাতে পারব না ভাই! যারা বাড়িতে থাকে, তাদের দেখে আমার মনে হয়, এতে তাদের লাভ কি? কাজেই এর ঠিক কোন উত্তর হয় না।
রমাপতি চুপ করে রইল। তার মুখ দেখে বুঝলাম আমার উত্তরটা তার বিশেষ পছন্দ হয়নি, সে বুঝতেও পারেনি। গৃহত্যাগ করে বিদেশে গিয়ে অর্থ উপার্জন করলে বোঝা যায়, বাড়ি থেকে পালিয়ে সাধু-সন্ন্যাসী হলে তারও যাহোক একটা মানে হয়— কারণ তেমনটা বহু ঘটতে দেখা গিয়েছে। কিন্তু সে-সব কিছু নয় খামোক একজন মানুষ বাড়ির আরাম ছেড়ে পথে পথে বেড়িয়ে বেড়ায়—এর কারণ সে ধরতে পারছে না।
চা খেতে খেতে রমাপতি বলল—তুই তো বেশ অনেকদিন বাড়ি ছেড়েছিস, তাই?
-হ্যাঁ।
—যেতে বাধা আছে কোন?
—না, বাধা আর কি? আমি তো আর গৃহত্যাগ করে সন্ন্যাসী হইনি—তোকে বললাম না? যখন ইচ্ছে করবে চলে যাব।
চায়ের কাপ দোকানীকে ফেরত দিয়ে রমাপতি একটু ইতস্তত করে বললতারানাথ, তোর বোধহয় এখন একবার বাড়ি যাওয়া উচিত
তার গলায় কেমন একটা সুর ছিল, ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম—কেন বল তো? হঠাৎ বাড়ি যাব কেন?
–কাকীমার খুব অসুখ। অবস্থা তেমন একটা—মানে, কখন কি হয় বলা যায় না। তুই একবার যা–
বিশ্বে মাতৃশক্তি একটা খুব বড় শক্তি। আমার পথে পথে বেড়ানো যাযাবর জীবন, সাধুসঙ্গে আগ্রহ, সিদ্ধিলাভের আকাক্ষা—সব কোথায় উড়ে গেল। মনে হল, যার নাড়ি ছিড়ে ভূমিষ্ঠ হয়েছি, যার কোলে খেলা করে বড় হয়েছি—আমার সেই চিরপরিচিত সদাহাস্যমুখী মা অসুস্থ। তিনি হয়ত আমাকে দেখতে চান—আমি এখুনি বাড়ি যাব।
কি ভয়ানক বৃষ্টি। থামবার নাম নেই। তারই মধ্যে ভিজতে ভিজতে পরের দিন দুপুর নাগাদ বাড়ি পৌঁছলাম। মানুষের মনের সঙ্গে শরীরের একটা ঘনিষ্ঠ যোগ আছে। মায়ের রোগশয্যার পাশে গিয়ে দাঁড়াতে আমাকে দেখে তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বিছানায় বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে জিজ্ঞাসা করলাম—এখন কেমন আছ মা?
উত্তরে মা শীর্ণ হাত দিয়ে আমার চিবুক ছুঁয়ে বললেন—ভয় নেই খোকা, তুই এসে পড়েছিস-এ যাত্রা আমি আর মরব না।
সত্যই পরের দিন থেকে মায়ের অবস্থা ভালোর দিকে যেতে লাগল। আমি ফেরায় বাড়ির লোকও খুশি। খাইদাই আর চণ্ডীমণ্ডপে বসে বৃষ্টি দেখি। চার-পাচদিন ধরে নাগাড়ে বর্ষা চলেছে। গ্রামের সব পথে একটু কাদা, খালবিল আর মাঠ একাকার হয়ে গিয়েছে জলে। আমাদের পুরনো কৃষাণ বনমালী ভিজতে ভিজতে বলল— দাদাবাবু, এমন কাণ্ড জন্মে দেখিনি। সারা গা থৈ থৈ করছে, পাচু হালদারের বাঁশবাগানে একহাটু জল! তার চে আশ্চর্য কইখালির মাঠে মাছ খেলছে দেখে এলাম শিং-মাগুর, পোনার চারা, কই-শয়ে শয়ে মাছ!