চটকগাছের গুড়িতে হেলান দিয়ে আমি মুহ্যমানের মত বসে রইলাম, মাঠের ওপর দিয়ে তার শুয়োর তাড়িয়ে নিয়ে লোকটা কোথায় যেন চলে গেল। সে কোথায় যাচ্ছে, কি করে আবার দেখা হবে কিছুই জিজ্ঞাসা করা হল না।
কিন্তু কি মনখারাপই সে আমাকে দিয়ে গেল!
এরপর আমার আর কিছু ভাল লাগত না। একা তো ছিলামই, আরও একা হয়ে গেলাম। সবসময় মনে হত কি একটা কাজ যেন ফেলে রেখেছি, কোথায় যেন আমাকে চলে যেতে হবে।
প্রথম যৌবনে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ি, সে কথা তোমাদের বলেছি। বীরভূমের শ্মশানে মাতু পাগলী আমাকে সম্মােহিত করে নানা দৃশ্য দেখিয়েছিল। আমি যেন নদীর জলে নেমে গাছের শেকড়ে আটকে থাকা মৃতদেহ তুলে এনে পূজার উপকরণ সংগ্রহ করে শবসাধনায় বসলাম। সারারাত কত আতঙ্কজনক দৃশ্য দেখলাম, কত উপদ্রব ঘটল। পরে সম্বিত ফিরে পেয়ে দেখি ধূসর সন্ধ্যায় নির্জন শ্মশানে দাঁড়িয়ে আমি মাতু পাগলীর সামনে—মাত্র দশমিনিট সময় কেটেছে। এ তো গেল ভেলকি, কিন্তু সদগুরুর সাহায্যে আমি প্রকৃতই একবার শবসাধনা করেছিলাম। মুর্শিদাবাদ জেলার এক অজ পাড়াগায়ের শ্মশানে তখন আস্তানা গেড়েছি—সঙ্গে গুরু রয়েছেন। জ্যৈষ্ঠের শেষে আশেপাশের গ্রামগুলোতে কলেরার মহামার শুরু হল। সারাদিন ধরে দূর দূরান্ত থেকে মৃতদেহ দাহ করতে আনছে লোকে। পরে এমন অবস্থা দাঁড়াল, দাহ করার কাঠ জোটে না। মুখে আগুন ছুইয়ে দেহ ফেলে শ্মশানবন্ধুরা পালায়। তারই ভেতর থেকে লক্ষ্মণযুক্ত একটি মৃতদেহ একদিন তুলে নিয়ে এলাম। শ্মশানের পূর্বপ্রান্তে একটু জঙ্গলমত জায়গা, সেখানে বিরাট একটা বাকড়া ছাতিমগাছ রয়েছে। তারই তলায় গুরু পূজার আয়োজন করলেন। রাত্তিরে দাহ করার জন্য দলবল এলেও এদিকে তারা যেসবে না।
আমি ভেবেছিলাম গুরুই বোধহয় শবাসনে বসবেন। কিন্তু প্রাথমিক প্রকরণের শেষে গুরু যখন আমাকে পদ্মবীজের মালা ধারণ করতে বললেন, তখন অবাক হয়ে বললাম—আমি কেন?
-–তুমিই তো আসনে বসবে?
—আমি। আমি কি পারব?
—নিশ্চয় পারবে, আমি তোমাকে আমার শক্তির অংশ দান করব। তাছাড়া এ আমার কাছে আল আর হুগলি হে আল ক্ষা তোমারই অধিকার।
ঘোর অমাবস্যার মধ্যরাত্রি। গুরু আমাকে আসনে বসিয়ে দিয়ে সকালে আসব। বলে চলে গেলেন। শব সাধনার সময় সামনে অন্য সাধকের উপস্থিত থাকতে নেই।
সাষ্টাঙ্গ প্রণামের ভঙ্গিতে উপুড় করে শোয়ানো মৃতদেহের পিঠের ওপর বজ্রাসনে বসে বীজমন্ত্র জপ আরম্ভ করলাম। মনে কোন ভয় নেই। বহুদিন হল তান্ত্রিক সাধুসঙ্গ করছি, অনেক অস্বাভাবিক আর অলৌকিক ঘটনা চোখের সামনে ঘটতে দেখেছি। আমি জানি নিখুঁতভাবে দেহশুদ্ধি করে আসনে বসলে কোন বিপদ সাধককে স্পর্শ করে না। ঘণ্টাখানেক একমনে জপ চালাবার পরে অনুভব করলাম নিচে মৃতদেহটা যেন নড়ে উঠছে, তাতে প্রাণের স্পন্দন জেগেছে। পোড়া মাছ গুজে দিলাম শবের মুখে, নরকপাল থেকে একটু একটু করে কারণ ঢেলে দিতে লাগলাম। শব আবার শাস্ত হয়ে এল। আরও তিনবার এমন হল সে রাত্তিরে। সাধনায় বিঘ্ন সৃষ্টি করবার জন্য হাকিনীরা কত বীভৎস রূপ ধারণ করে এল— দিয়ে নৃত্য করছে। যে কোন সাধারণ মানুষের হৃৎপিণ্ড থামিয়ে দেবার পক্ষে এ দৃশ্য যথেষ্ট। সে মুহূর্তে বুক যে একটু কেঁপে ওঠেনি তা বলব না। প্রাণপণে মনকে একাগ্র করে বীজমন্ত্র জপ করতে লাগলাম, ধীরে ধীরে মিলিয়ে এল প্রেতের দল।
অনেকের মধ্যেই ভুল ধারণা আছে যে, একরাত শবসাধনা করলেই বুঝি সিদ্ধিলাভ হয়। বিশেষ বিশেষ তিথিতে কয়েকবার আসনে বসলে তবেই সিদ্ধি আসে। এতে অনেকবছরও লেগে যেতে পারে। ধরো, তিথি সুপ্রশস্ত, পূজার সব আয়োজনই করা হয়েছে, কিন্তু শেষপর্যন্ত শব পাওয়া গেল না। সব পণ্ড। আমারও তাই হয়েছিল। নানা কারণে ওই একবার ছাড়া আর শবসাধনা করতে পারিনি। গুরুর কাছ থেকে যখন বিদায় নিয়ে আসি তখন তিনি সাবধান করে বলেছিলেন—শোনো, সময়মত সাধনা সম্পূর্ণ কোরো। তোমাকে তো সবই শিখিয়ে দিয়েছি, আমি না থাকলেও অসুবিধে হবে না। নইলে কিন্তু বিপদ–
—আজ্ঞে, কি রকম বিপদ?
–ভয়ঙ্কর বিপদ। মৃত্যুর পরে আত্মা সঙ্গে সঙ্গে উর্ধ্বগতি পায় না। বেশ কিছুক্ষণ নিজের প্রাণহীন দেহটার কাছে ঘোরাফেরা করে। যার দেহ নিয়ে শবসাধনা করা হয়, তার আত্মা দেখতে পায় দেহের সৎকার হয়নি বরং সেটা সাধক নিজের কাজে লাগিয়েছে। তাতে মৃতের আত্মা নিশ্চয় খুশি হয় না। সে প্রতিশোধ গ্রহণের সুযোগ খোজে। সাধনা সম্পূর্ণ করলে সাধক অমিত শক্তিলাভ করে, ফলে তার আর ভয় থাকে না। নইলে বুঝতেই পারছ কি বিপদ হতে পারে! সাবধানে থেকে, জানো তো, প্রবাদ আছে—সাপুড়ের মরণ সাপের হাতে। তোমার ভাগ্য আমি গণনা করে দেখেছি, তুমি একটানা সাধনা করতে পারবে না, আবার তোমাকে ফিরে যেতে হবে গৃহাশ্রমে। আবার বেরুবে—এবং ফিরে যাবে। এইভাবেই চলবে। শবসাধনা গৃহে বসে করবার জিনিস নয়। কাজেই একেবারে অসম্ভব হয়ে পড়ার আগে কর্ম সম্পূর্ণ করে রেখো।
তারপর আমার দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে গুরু বললেন-কিন্তু তোমার কপালে একটা আশ্চর্য যোগাযোগের চিহ্ন রয়েছে। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। খুব বড় একজন। মহাপুরুষ, কিংবা মহাসাধক তোমাকে কৃপা করবেন। দেখি হাতটা–
ডান হাত বাড়িয়ে দিলাম। উনি হাতটা ধরলেন, কিন্তু দেখলেন না, তাকিয়ে। রইলেন আমার দিকে। বললাম—কি ধরনের মহাপুরুষ?