সাধু বলে চলেছে—সেই মাধব ঘোষের বড় মেয়েটির দেহে প্রকৃত সাধন-সঙ্গিনী হবার উপযুক্ত সমস্ত লক্ষণ বর্তমান ছিল। আমার বর্তমানে কোনো ভৈরবী নেই। আমি পরদিন সকালে মাধব ঘোষের কাছে সাধনার জন্য মেয়েটিকে চাইলাম। মাধব দিল তো নাই, উপরন্তু আমাকে অকথ্য অপমান করে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিল। সে অপমান আমার বুকে কাটার মত বিঁধে আছে। বেরিয়ে আসবার সময় মাধব আমার ঘাড়ে হাত দিয়ে একটা ধাক্কাও দিয়েছিল। আমার গায়ে হাত! আচ্ছা! মাধব ঘোষ এইবার দেখব তোমাকে–
আমি ভয় পেয়ে বললাম—কি করবেন আপনি?
–করবো কি? করেছি—এই যে বেতাল জাগিয়ে পাঠালাম, কোথায় গেল সে? পাঠালাম ওই মাধব ঘোষের বাড়ি। এইবার সে বুঝবে কাকে সে অপমান করেছিল।
-–কি হবে মাধব ঘোষের?
—আজ তার নিজের ক্ষতি কিছু হবে না। আজ তার বাড়িতে একটা কিছু করে আসবে বেতাল। এক পক্ষ ধরে আমি বেতাল মন্ত্র জপ করে আজ আহুতি দিয়েছি। কাল অমাবস্যা, কাল পূর্ণাহুতি দেব হোম করে। ওই যে নিমকাঠের পুতুল দেখছ, ওটা হচ্ছে মাধব ঘোষের প্রতিমূর্তি। ওই পুতুলে কাল প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে বেতালকে চিনিয়ে দেব! তারপর বেতাল আবার কাল যাবে মাধবের বাড়ি। তারপর? তারপর পরশু মাধব ঘোষের মৃতদেহ পড়ে থাকবে উঠোনে, কি আমবাগানের মধ্যে। ভয়ঙ্কর–বীভৎস অপমৃত্যু! কেউ কিচ্ছুটি টের পাবে না কোথা দিয়ে কি হল।
সাধুর মুখখানা এখন আমার কাছে নেকড়ে বাঘের মত লাগছিল। আমি আর সহ্য না করতে পেরে বললাম, কিন্তু এ আপনি অন্যায় করছেন। এ ঠিক নয়।
সাধুর চোখ আবার ধ্বক করে জ্বলে উঠল। পৈশাচিক ক্রোধে মুখ বিকৃত করে সে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, কি বলতে চাস তুইঃ আমি অন্যায় করছি?
আমার যেন কেমন সাহস এসে গেল। বললাম, নিশ্চয় অন্যায়। আপনি এই কুকর্মে লিপ্ত আছেন জানলে আমি একদিনও থাকতাম না এখানে প্রতিহিংসা সাধনের জন্য নরহত্যা মহা অধর্ম।
-মূর্খ। কাপালিকের পক্ষে প্রতিহিংসা সাধন অধর্ম নয়। তুই তার কি বুঝবি?
—থামুন। আপনার মত নরকের কৃমিকীটের কাছে আর নয়। আমি চললাম। আপনি থাকুন আপনার কুৎসিত সাধনা নিয়ে–
হনহন করে হেঁটে সেই রাত্তিরেই রওনা দিলাম শ্মশান থেকে। পেছনে সাধু ডেকে বলল, যাচ্ছিস যা! কিন্তু শুনে যা—আজ পর্যন্ত কেউ আমাকে অপমান করে বেশিদিন পৃথিবীর আলো দেখেনি। মনে রাখিস–
অনেক দূর চলে এসেছি, তখনও পেছন থেকে রাত্তিরের নির্জনতা ভেদ করে সাধুর উন্মাদের মত হাসি শুনতে পাচ্ছিলাম।
পরের দিন দুপুর গড়িয়ে গেলে অবিশ্রান্ত হেঁটে আমি মাধব ঘোষের বাড়ি পৌঁছলাম। দেখি, সমস্ত বাড়িটা যেন কেমন ঝিমিয়ে আছে। ভেতরে কেউ যেন জেগে নেই। আমার বুকটা ছাৎ করে উঠল। না জানি বেতাল কাল রাত্তিরে কি করে গিয়েছে।
উঠোনে দাঁড়িয়ে ডাক দিলাম, মাধব! মাধব।
ডাক শুনে ভেতর থেকে মাধব বেরিয়ে এল। আমাকে দেখে সে যেন হাতে চাঁদ পেল। এগিয়ে এসে পায়ের ধুলো নিয়ে বলল, ঠাকুরমশায়! ওঃ আপনি এসেছেন। আমি যেন একটু বল পেলাম। ভগবান পাঠিয়েছেন আপনাকে—
দেখলাম মাধবের চোখ বসে গিয়েছে, মুখ শুকনো। বললাম, কি হয়েছে? কোন বিপদআপদ হয়নি তো?
—আর বিপদ! গতকাল রাত্তিরে আমার দু-খানা গাই-গরু মরে গেল ঠাকুরমশাই!
—সে কি! গরু মারা গেল কি করে?
—তা কি করে বলি বলুন দিকনি ঠাকুরমশাই? আশ্চর্য ব্যাপার! তখন অনেক রাত, হঠাৎ গোয়ালে কেমন একটা শব্দ শুনলাম, মনে হল গরুগুলো যেন ভয় পেয়ে ছটফট করছে। উঠে বাইরে যাবার আগেই মুংলি গাইটা চিৎকার করে উঠল। গিয়ে দেখি রাঙি আর মুংলি দুটোই মাটিতে শুয়ে ছটফট করছে। কি হল কে জানে! তক্ষুনি লোক পাঠালাম পাশের গায়ে গো-বদ্যির জন্য। সে এল বটে, কিন্তু কিছুই বুঝতে পারলে না| আজ সকালে মারা গেল গরু দুটো।
মাধবের চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল। বলল, আজ সকাল থেকে আবার মেয়েটার জুর, গা যেন পুড়ে যাচ্ছে। এসব তো ভাল কথা নয় ঠাকুরমশাই। আপনি এলেন ভালই হল। ব্রাহ্মণ মানুষ, ভিটেয় বাস করলে আমার ভয় কেটে যাবে।
বুঝলাম সবই। কিন্তু আমার কি করার আছে কিছুই বুঝতে পারলাম না। আমি থাকলে যদি মাধব শান্তি পায়, তাহলে থাকতে পারি—এই মাত্র।
একটু পরেই একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল।
তখন বিকেল বেশ গাঢ় হয়ে এসেছে। মাধব ঘোষ বেশ করে ফলারের আয়োজন করে দিয়েছিল। ফলার করে আমার একটু বাগানে যাবার প্রয়োজন হয়ে পড়ল। মাধবের কাছ থেকে গড় চেয়ে বাগান সারলাম। গড় হাতে ফিরছি, হঠাৎ মনের মধ্যে কেমন যেন একটা অনুভূতি জেগে উঠল। ঠিক কি রকম তা বোঝাতে পারব না। যেন আমার খুব বড় একটা বিপদ আসছে। খুব কাছে এসে গিয়েছে সে বিপদ। ভয়ের একটা বিচিত্র অনুভূতি বুকের মধ্যে ঠেলে উঠল। সেই অন্ধকার নির্জন আমবাগানে। দাঁড়িয়ে হঠাৎই আমার বুক যেন হিম হয়ে গেল। কেন এরকম হচ্ছে আমার?
তাড়াতাড়ি ফেরবার জন্য এগুতে গিয়ে মনে হল কয়েক হাত দূরে একটা আমগাছের গুড়ির পাশে কে যেন চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে।
আর একটু হলে বোধহয় ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠতাম, কিন্তু ততক্ষণে যে দাঁড়িয়ে আছে তাকে আমি চিনতে পেরেছি।
আমাদের গাঁয়ের বটতলার সেই সৌম্যমূর্তি সাধু। যিনি বলেছিলেন আমার বিপদ ঘনিয়ে এলেই আমাকে দেখা দেবেন। তাহলে কি সত্যিই আমার আজ সেই বিপদের দিন এসেছে?
দূর থেকেই আমি সাধুকে প্রণাম করলাম। সাধু হেসে হাত তুলে আশীর্বাদ করলেন। তারপর হঠাৎ কোথায় সাধু কোথায় কি কেউ নেই কোথাও? আমি এক অন্ধকারে গড় হাতে দাঁড়িয়ে।