আমি যে ঘরে ঢুকেছি তা বোধ হয় তারানাথ লক্ষ্যই করেনি, একটু চমকে উঠে বলল—ও, তুমিএস!, বোস ওইখানটায়। না মনখারাপ নয়, অনেকদিন আগেকার কথা ভাবছিলাম ছোটবেলার কথা। পুরনো দিনের কথা মনে এলে একটু মন খারাপ তো হয়ই, না? কিশোরী এল না যে?
-আসবে। তাকে সকালে বলে রেখেছি, অফিসের পরে সোজা এখানে চলে আসবে।
নাম করতে করতেই কিশোরী এসে পড়ল।—কি, গল্প শুরু হয়ে গিয়েছে নাকি?
তারানাথ বলল—না, বোসো। তোমার কথাই হচ্ছিল। আজ গল্প বলার মেজাজ নেই, আর একদিন হবে’খন। চা খাবে?
বাড়ির ভেতরে গিয়ে চায়ের কথা বলে এসে তারানাথ আবার তক্তাপপাশে বসে হুঁকো টানতে লাগল। আমি আর কিশোরী জানি গল্প হবে না কথাটার বিশেষ কোন গুরুত্ব নেই। অপেক্ষা করলে একটা ভাল গল্প বেরিয়ে আসতেও পারে।
কয়েকটা ব্যর্থ টান দিয়ে বিরক্তমুখে হুঁকো নামিয়ে রাখতে রাখতে তারানাথ বলল— দুত্তোরিবোস তো!এটা আবার গেল নিবে!মরা, চারিকে বলে আসি একছিলিম সেজে দিতে—
কিশোরী পকেট থেকে নতুন পাসিং শো-এর প্যাকেট বের করে (মাসের প্রথম, এ সময়টা আমরা একটু নবাবী করেই থাকি) তক্তাপোশে রেখে বলল–বসুন ঠাকুরমশাই, বারবার উঠতে হবে না, সিগারেট খান—
তারানাথ উজ্জ্বলমুখে একটা সিগারেট বের করে ধরাতে ধরাতে বলল—সে বরং ভাল। হুকোকলকে আমাদের দেশে আর চলবে না, বুঝলে? কত ফৈজৎ, তামাকটিকের যোগাড় রাখ, ঠিক্রে লাগাও-ছিলিম সাজ, একঘণ্টা ধরে ফুঁ দাও—নাঃ, সিগারেটই ভাল–
চোখ বুজে সিগারেটে টান দিতে দিতে একটু পরে তারানাথ বলল—তবে কি জানো? তামাকের মৌজ সিগারেট নেই। এই যে সোদা সোদা গন্ধ, কড়া ধাক, গুড়ুক গুড়ুক শব্দ-সব মিলিয়ে একটা দারুণ আমেজ। তারপরে ধরো, ঠিক্রে গুজছি, তামাক আর টিকে সাজাচ্ছি, মনোযোগ দিয়ে ফুঁ দিচ্ছি, আর মনের ভেতর এই হয়ে গেল— এক্ষুনি আমি তামাক খাব–এই ভাব। সেটাও একরকমের মেজাজ, ওই অপেক্ষাটা। আর সিগারেট কি, না—এই ধরালাম, দুদশটা টান দিয়ে ফেলে দিলাম-—চুকে গেল। তা মানুষের হাতে সময় কমে আসছে, করবে কি? এই সিগারেটই বাজার দখল করবে দেখ—
কিশোরী বলল—পুরনো দিনের কথা ভাবছিলেন বললেন না? আপনার ছোটবেলার ঘটনাই বলুন না, শোনা যাক।
ছাইদানী হিসেবে ব্যবহৃত নারকোলের মালায় সিগারেটের দগ্ধাবশেষ গুঁজে দিয়ে তারানাথ বলল—সে তো আর একটা টানা গল্প নয়, কত বছর ধরে টুকিটাকি কত কিছু ঘটেছে আমার কাছে সেসবের গভীর মূল্য আছে-কিন্তু তোমাদের ভাল লাগবে কেন?
আমি জিজ্ঞাসা করলাম—আচ্ছা, তন্ত্রসাধনার দিকে প্রথম আপনার বোক আসে কি করে?
—সে তো তোমাদের বলেছি, গ্রামের বাঁধানো গাছতলায় সেই সাধু, তারপর বীরভূমের শ্মশানের সেই মাতঙ্গিনী—সে আবার ডামরতন্ত্রে সিদ্ধ ছিল, কিংবা বরাকর নদীর ধারের সাধুজী, যার পঞ্চমুতী আসনে বসে মধুসুন্দরী দেবীকে দেখতে পাই। এদেরই প্রভাবে এ পথে আসি—এ গল্প তো তোমরা শুনেছ।
বললাম—কিন্তু তারও আগে?
একেবারে ছোটবেলায় কবে বুঝলেন যে আপনার জীবনটা ঠিক অন্য সবার মত হবে না? তারানাথ দুই আঙুলে ভ্রর মাঝখানটা টিপে ধরে রইল কিছুক্ষণ-, তারপর মুখ তুলে আস্তে আস্তে বলল—জন্মের সময় থেকেই বোধ হয় ঈশ্বর আমার জীবনের গতিপথ নির্ণয় করে দিয়েছিলেন। আমি যখন ভূমিষ্ঠ হই সেই মুহূর্তে আকাশ দিয়ে একটা বিরাট উল্কা ছুটে গিয়েছিল। মা আঁতুড়ঘরে, গ্রামের বৌ ঝিরা তাকে ঘিরে–বসে রয়েছে, বাবা পায়চারী করছেন দক্ষিণের বারান্দায়। গরম জল নেবার জন্য সিন্ধুবালা দাই আঁতুড়ঘর থেকে উঠোন পেরিয়ে রান্নাবাড়ির দিকে আসছিল। সেই–হঠাৎ আকাশে আশ্চর্য আলো দেখতে পেয়ে চিৎকার করে ওঠে। তার ডাকে বাড়ির সবাই উঠোনে এসে জড়ো হল। অদ্ভুত নীল আলোয় চারিদিক উদ্ভাসিত করে একটা নীল আগুনের গোলক পুবদিক থেকে পশ্চিম দিগন্তের দিকে চলে যাচ্ছে। সাধারণত উল্কা জ্বলে উঠেই চকিতে মিলিয়ে যায়, লোকজন ডেকে এনে দেখবার অবকাশ পাওয়া যায় না। এই নীল আলো কিন্তু অনেক অনেক ওপর দিয়ে বেশ সময় নিয়ে পার হয়ে যাচ্ছে, ধূমকেতুর মত একটা অস্পষ্ট স্বতঃপ্রভ ধোয়ার পথরেখা ফেলে যাচ্ছে পেছনে।
পশ্চিমদিগন্তে নীল উল্কা মিলিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে আমি ভূমিষ্ঠ হই।
এ গল্প পরে বড় হয়ে সবার মুখে শুনেছি। সে বয়েসটা একটা অদ্ভুত বয়েস, বুঝলে? রেড়ির তেলের প্রদীপ, ছোট ছোট ফোড় দেওয়া পদ্মকাথা, আরামদায়ক রোদঝিমঝিম করা নির্জন দুপুর, উঠোনের চাটাইতে শুকোতে দেওয়া টোপাকুলের ভরপুর গন্ধ, রাত্তিরে জ্যোৎস্নায় চকচক করা নারকোল গাছের পাতা—সে সময়ে সবই সম্ভব ছিল। সমবয়েসীদের সঙ্গে বনতো না, তাদের খেলাধুলো কথাবার্তা কেমন অর্থহীন আর হাস্যকর বলে মনে হত। একা একা বেড়াতাম মাঠেবনে, গ্রামের বাইরে যাবার পথে চৌধুরীদের বাঁশবাগানে। একটা জিনিস খুব অনুভব করতাম, এখনো ভাবলে মন উদাস হয়ে যায়। ধরো, খাওয়াদাওয়া সেরে বাড়ির সকলে দুপুরের ঘুম–দিচ্ছে, আমি বেরিয়ে চলে গিয়েছি সাঁতরাদ্দীঘির পারে। চুপ করে বসে আছি। বিরঝিরে বাতাসে দীঘির জলে ডুরে ডুরে ঢেউ উঠেছে। লিচু আর জামরুল গাছের পাতার ফাক দিয়ে সূর্যের আলো এসে মাটিতে রোদ আর ছায়ার আলপনা তৈরি করছে—আমগাছের গুঁড়ি বেয়ে উঠছে একসারি কাঠপিপড়ে। এইসব নির্জন মুহূর্তে, আমি তোমাদের সত্যি বলছি, স্পষ্ট শুনতে পেতাম গাছপালা, মাটি, দীঘির জল আমার সঙ্গে কথা বলছে। ঠিক কোন ভাষা দিয়ে নয়, সে ভাষা ওদের নেই। এ অনেকটা গানের সুরের মত—কিম্বা তাও ঠিক নয়, এমন একটা কিছু—যা মন দিয়ে বোঝা যায় কিন্তু মুখ দিয়ে বলা যায় না। পরে সাধনা করতে গিয়ে দেখেছি উচ্চকোটির তন্ত্রসাধকেরও স্বীকার করেছেন যে, আমরা যাদের নিজীব পদার্থ ভাবি তাদেরও প্রাণ আছে চেতনা আছে। এখন ভাবলে বিস্মিত হই, তখন কিন্তু ব্যাপারটাকে খুবই স্বাভাবিকভাবে নিয়েছিলাম। ভাবতাম, সবাই বুঝি আমার মতই ওদের কথা শুনতে পায়।