কখন যেন আমার ঠিক গা ঘেঁষে এসে দাঁড়িয়েছে একটা বাঘের মত মিশমিশে কালো কুকুর। তার প্রগাঢ় নিঃশ্বাসের শব্দ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি। একদৃষ্টে সে ঝোপের ফাক দিয়ে হরিপদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
হরিপদও বোধহয় কিছু শুনতে পেয়েছিল। সে ফিরে দাঁড়িয়েছে, তার সমস্ত শরীর শক্ত, শাবলটা শক্ত করে ধরে আছে।
একটা গম্ভীর গর্জন করে কুকুরটা লাফিয়ে গিয়ে হরিপদর সামনে খোলা উঠোনে পড়ল। একবার সেদিকে তাকিয়েই মহাতঙ্কে তীব্র আর্তনাদ করে উঠল হরিপদ। আমি এমন রক্তজমানো ভয়ের আর্তনাদ আর কখনো শুনিনি। সঙ্গে সঙ্গে হরিপদ হাতের শাবলটা সজোরে ছুড়ে দিল কুকুরটার দিকে। ভারী লোহার শাবল ডানপায়ের থাবায় এসে লাগতেই কুকুরটা আর একবার তীব্র গর্জন করে হরিপদর ওপর লাফিয়ে পড়ল।
সুড়িপথের দিকে কাদের গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে, বেশ অনেক মানুষের কণ্ঠ। এতক্ষণে কি এলেন বিশুঠাকুর?
আমি ততক্ষণে উত্তেজনায় আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে এসেছি, কেন যেন বুঝতে পেরে গিয়েছি হরিপদকে আর ভয় করবার কোন কারণ নেই।
শিবরামের গলা শোনা যাচ্ছে—ভয় নেই ঠাকুরমশাই, এই যে আমরা সবাই এসে পড়েছি!
এদিকে উঠোনে মাটিতে পড়ে দুহাত দিয়ে আত্মরক্ষার ব্যর্থ চেষ্টা করছে হরিপদ, কি এক অপার্থিব আতঙ্ক দেখে যেন তার নিজের পেশীর ওপর সব কর্তৃত্ব চলে গিয়েছে। তার বুকের ওপর শরীরের উর্ধ্বাংশ চাপিয়ে দিয়ে গলায় দাঁত বসাবার সুযোগ খুঁজছে কুকুরটা, ডানথাবা দিয়ে ঝরঝর করে রক্ত পড়ছে, সেদিকে তার কোন ভ্রূক্ষেপ নেই।
আমার পাশে লোকজন নিয়ে পৌঁছে গিয়েছে শিবরাম, গ্রামের আরও লোকজন। ছুটে আসছে, তাদেরও গলার শব্দ শুনতে পাচ্ছি।
কুকুরটার দিকে একবার তাকিয়েই শিবরাম চিৎকার করে উঠল—কেতু। তুই কোথা থেকে এলি?
কেতু তখন হরিপদর টুটি কামড়ে ধরেছে, হরিপদর দু-হাত অবশ হয়ে এলিয়ে পড়েছে দুদিকে। কেবল পা-দুটো পর্যায়ক্রমে মৃত্যুবিক্ষেপে সামনে পেছনে নড়ে অদৃশ্য কি একটা বস্তু যেন ঠেলে দেবার চেষ্টা করছে।
শ্রীদাম ঘোষ সহ গ্রামের আরও অনেকে এসে পড়ে বিস্তারিত চোখে উঠোনের ভয়াবহ দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে আছে।
শিবরাম বলল—কিন্তু লোকটা কে? হরিপদ না? বললাম—হ্যাঁ।
এতক্ষণে সম্বিত ফিরে পেয়ে শিবরামের কৃষাণের লাঠি উচিয়ে তাড়া করে গেল। কেতু সরে গিয়ে মুখ তুলে তাকাল একবার। তার কষ বেয়ে গড়াচ্ছে তাজা রক্ত।
তারপরই একলাফে কেতু পাশের ঝোপে পড়ে মিলিয়ে গেল। শোনা গৈল শুকনো বাঁশপাতার ওপর তার পায়ের শব্দ দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে।
কৃষাণেরা যখন ধরাধরি করে হরিপদর দেহ রামরাম ঘোষালের চালাঘরের দাওয়ায় এনে রাখল, তখন সে দেহে আর প্রাণ নেই।
শিবরাম বলল—শেষে হরিপদ এই কাজ করল। দাদা ওকে নিজের ছেলের মতন ভালবাসতেন।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম—ঠাকুরমশাই কোথায়?
—তিনি তো আপনার সঙ্গে ছিলেন, আপনার সঙ্গেই থাকবার কথা। আপনি জানেন না?
বিশুঠাকুর আর এলেনই না। পরের দিন সকালে আমিও স্টেশনের দিকে বেরিয়ে পড়লাম! আর থেকে কি হবে? পুলিশে খবর দেওয়া হয়েছে—এবার তাদের কাজ তারা করবে। কোন মামলাও বোধহয় হবে না এ নিয়ে। অন্তত ত্রিশজন গ্রামবাসী ঘটনাটা নিজের চোখে দেখেছে— পাগলা কুকুরের আক্রমণে জনৈক গ্রামবাসীর করুণ মৃত্যু। মামলা আর কি হবে?
কিন্তু কেতু এল কোথা থেকে?
উত্তরটা পেলাম বিশুঠাকুরের সঙ্গে দেখা হবার পর। তিনি পরম প্রশান্তমুখে প্ল্যাটফর্মের চায়ের দোকানে বসে গরম চা খাচ্ছিলেন—আমাকে দেখে বললেন—এই যে তারানাথ এসো। চা খাবে? আমার আর কালকে যাওয়া হল না, বুঝলে? তুমি চলে যাবার পর—বললে বিশ্বাস করবে না—ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। একঘুমে একদম রাত কাবার। জেগে দেখি ভোর হয়ে এসেছে। ভাবলাম আর এতটা পথ হেঁটে কি হবে? তুমি নিশ্চয় এসে পড়বে সকালে। তা কি হল বল রাত্তিরে? খামোকা জাগতে হোল তো?
নিতান্ত গা জ্বালা করা সত্ত্বেও সমস্ত ঘটনাটা তাকে বললাম। তাঁর বিশেষ কোনো ভাবপরিবর্তন হল বলে মনে হল না। চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে পেয়ালা নামিয়ে রাখতে রাখতে বললেন—যাঃ! শেষ অবধি হরিপদর এই কাজ! ব্যাটা একেবারে নরাধম, ঠিক। শাস্তি হয়েছে।
—আপনি বলেছিলেন কেতু মারা গেছে।
-ভুল বলেছিলাম। বেঁচে আছে তো দেখাই যাচ্ছে। যাক গে, ট্রেনের প্রথম ঘণ্টা পড়ছে—টিকিট কাটো গে যাও।
একটু চুপ করে থেকে বললাম—আমি আপনার সঙ্গে আর যাব না—
—কোথায় যাবে তবে?
—কোলকাতার দিকে যাব। কাজ আছে।
বিশুঠাকুর হেসে বললেন—বেশ, তাই যেয়ো। আমাকে ট্রেনে তুলে দাও অন্তত। তোমার গাড়ির তো দেরি আছে।
গাড়িতে তুলতে গিয়ে খেয়াল করলাম বিশুঠাকুর খোড়াচ্ছেন, ডানপায়ের পাতায় ন্যাকড়ার পট্টি বাধা।
আমার বুকের ভেতরটা হিম হয়ে এল, বললাম—একি! আপনার পায়ে কি হয়েছে? কাল বিকেলেও তো দেখিনি
বিশুঠাকুর বললেন—ও কিছু নয়, প্ল্যাটফর্মের বেড়া পার হতে গিয়ে কাটা-তারে লেগে কেটে গিয়েছে।
আমি একদৃষ্টে বিশুঠাকুরের ডানপায়ের পট্টির দিকে তাকিয়ে আছি। হরিপদর সেই আর্তনাদ, শাবল ছুড়ে মারা—কেতুর ডানপায়ে রক্তের ধারা। তবে কি–
ট্রেন ছেড়ে দিল। জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বিশুঠাকুর হাসি হাসি মুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। সেই শেষ, আর কখনও তাকে দেখিনি।
১০. তারানাথ তামাক খাচ্ছে
সেদিন বিকেলে তারানাথের বাড়ি গিয়ে দেখি সে বাইরের ঘরে তক্তপোশের ওপর বসে তামাক খাচ্ছে। চোখমুখ উদাস। মাঝে মাঝে তারানাথের এ ধরনের ভাবপরিবর্তন দেখেছি, দুচারদিন থাকে, তারপর আবার ঠিক হয়ে যায়। বললাম—কি, মন খারাপ নাকি?