একটু ভেবে বললাম—কিন্তু আমরা তো কাল চলে যাচ্ছি, তাহলে এ ফাদ পেতে লাভ কি? খুনি এলেই বা তাকে ধরবে কে? আর ধরলেই বা কি প্রমাণ হবে? রাত্তিরে এই চালাঘরের কাছে ঘুরঘুর করছিল, কাজেই সে রামরাম ঘোষালকে মেরেছে—এমন যুক্তি কি আদালত শুনবে?
বিশুঠাকুর যথার্থ বিস্ময়ের সঙ্গে বললেন—আদালত? এর মধ্যে আদালত আসছে কোথা থেকে?
—তাহলে?
—পরে বলব। তুমি তো আমার সঙ্গে আছ, দেখতে পাবে।
চুপ করে বসে আছি, সময় গড়িয়ে যাচ্ছে। বিশুঠাকুর আপনমনে গুনগুন করে একটা শ্যামাসঙ্গীত গাইছেন।
শিবরাম দুধ নিয়ে এল।
-ভয় করছে না তো ঠাকুরমশাই?
—নাঃ। মায়ের নামগান করছি। ভয় কি?
–দরকার হলে চেঁচিয়ে ডাকবেন কিন্তু, কেমন?
—নিশ্চয়। তুমি চিন্তা কোরো না।
শিবরাম চলে গেলে ঠাকুরমশাই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন-শিবরামকে নিজে এসে দুধ দিয়ে যেতে বলেছিলাম কেন জানো?
—কেন?
—আমরা আসায় এ গ্রামের একজন নিশ্চয় স্বস্তি বোধ করছে না। সে কে, তা তো আমরা জানি না। তাই সাবধানে থাকাই ভাল। সামনে আক্রমণ না করলেও খাবারে বিষ মিশিয়ে দিতে বাধা কোথায়? দুধটা শিবরামের নিজের গরুর, নিশ্চিন্তে খেতে পারো–
-–খাব?
–খাও। শিবরাম তার দাদাকে খুন করেনি।
—কি করে বুঝলেন?
—আমি বুঝতে পারি।
নিজের পোটলা থেকে একটা পেতলের ঘটি বের করে তাতে অর্ধেক দুধ ঢেলে নিয়ে মাটির ভাঁড়টা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন–ধরো।
ঘটিতে একটা চুমুক দিয়ে বিশুঠাকুর বললেন—যে অন্যায় করে, মনে তার সবসময়ই ভয় থাকে—এই বুঝি ধরা পড়লাম! সবার দিকেই সে সন্দেহের চোখে তাকায়। তাই এই সাবধানতাটুকু নিতে হল। শুধু দুধ খেতে কষ্ট হচ্ছে, না?
লজ্জা পেয়ে বললাম—না না—
—আমারই ভুল। তুমি ছোকরা লোক, তোমার খিদে পেতেই পারে। কি খেতে ভালবাস তুমি?
হেসে বললাম—আমার এখন কিছু না হলেও চলবে। তবে একটু আগে মনে পড়ছিল ছোটবেলায় গ্রামের বিরিঞ্চি ময়রার দোকানের মাখা সন্দেশের কথা। মা দুধ আর মাখা সন্দেশ খেতে দিতেন মাঝেমাঝে, কোথায় গেল সে ছোটবেলা?
-মাখা সন্দেশ? মানে কাচাগোল্লা? ভাল মজা তো, আজই বিকেলে তোমার সঙ্গে দেখা হবার একটু আগে খানিকটা মাখা সন্দেশ কিনেছিলাম রাত্তিরে আর কিছু না জুটলে খাব বলে। আর তুমিও কিনা পৃথিবীতে এত জিনিস থাকতে মাখা সন্দেশ খেতে চাইলে। দাঁড়াও—
বিশুঠাকুর পোটলার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে একটা শালপাতার ঠোঙা বের করে আমার হাতে দিলেন।
ঠোঙার ভেতরে অনেকখানি কাচাগোল্লা।
ঠাকুরের দিকে তাকিয়ে বললাম—এটা আপনি বিকেলে কিনেছেন? আমার সঙ্গে দেখা হবার আগে?
-হ্যাঁ। কেন?
—এ সন্দেশ তো এখনো গরম রয়েছে।
একটু থতমত খেয়ে বিশুঠাকুর বললেন—বোঁচকার ভেতর ছিল তো, তাই গরম রয়ে গিয়েছে আর কি আপত্তি করে বললাম—তাই কখনও হতে পারে?
–হতে পারে নিশ্চয়, নইলে, হল কি করে? নাও, আর কথা না বাড়িয়ে খেয়ে ফেল দেখি। তারপর তুমি ঘুমোও, আমি জেগে থাকব।
শুয়ে শুয়ে অনেক রাত্তির অবধি দেখলাম বাঁশবনের মাথা দুলছে তারাভরা আকাশের পটভূমিকায়। ঘুম আসার আগে একবার জিজ্ঞাসা করলাম—আচ্ছা, কেতুর কি হল বলুন দেখি?
গম্ভীর গলায় বিশুঠাকুর উত্তর দিলেন—কেতুকে হত্যাকারী মেরে ফেলেছে, সম্ভবত বিষ মেশানো খাবার দিয়ে। চেনা লোক বলে কেতু চেঁচামেচি করেনি, হাত থেকে খাবারও নিয়েছে।
কিন্তু রামরামকে আঘাত করতে দেখলেই সে, আক্রমণ করত। কাজেই তাকে আগে সরানো একান্ত দরকার ছিল।
—দেহটা কোথায় গেল তাহলে?
-খুব সম্ভব শেয়ালে নিয়ে গিয়েছে। এসব অঞ্চলে সাবধানে দরজা দিয়ে না শুলে অনেকসময় ছোট শিশুকেও বিছানা থেকে শিয়ালে টেনে নিয়ে যায়। আবার শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি, ঘুম আসে না। হঠাৎ আর একটা প্রশ্ন মাথায় আসতে জিজ্ঞাসা করলাম—আচ্ছা, আপনি কেতুর গায়ের রঙের কথা জিজ্ঞাসা করলেন কেন? এটা আমি কিন্তু বুঝতে পারিনি–
চটে গিয়ে বিশুঠাকুর বললেন—বেশ করেছি জিজ্ঞেস করেছি, কেবল প্রশ্ন করে। ঘুমেও না কেন বাপু-কোন ব্যাপারটাই বা এ অবধি বুঝতে পেরেছ?
ঠাকুরকে আর না ঘটিয়ে বিনাবাক্যব্যয়ে পাশ ফিরে শুয়ে অচিরাৎ ঘুমিয়ে পড়লাম। সারারাত স্বপ্ন দেখলাম কেতু ল্যাজ নাড়তে নাড়তে বিশুঠাকুরের হাত থেকে মাখা সন্দেশ খাচ্ছে।
পরের দিন সকালে আমরা শিবরামের কাছে বিদায় নিয়ে চলে এলাম। সে আমাদের কয়েকটা দিন তার বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণের জন্য বিস্তর অনুরোধ করেছিল, কিন্তু বিশুঠাকুর রাজি হলেন না। তার নাকি কি কাজে আজই সিউড়ি রওনা হতে হবে, থাকার কোন উপায়ই নেই। পরে বরঞ্চ কখনও—ইত্যাদি।
শিবরাম, শ্রীদাম ঘোষ ইত্যাদি অনেকেই গ্রামের সীমানা পর্যন্ত আমাদের এগিয়ে দিয়ে গেল।
স্টেশনের কাছে একটা নির্জন জায়গায় এসে বিশুঠাকুর দাঁড়িয়ে পড়লেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন—তারানাথ, এখন আমি যা বলছি খুব মনোযোগ দিয়ে শোন। আমরা সিউড়ি যাচ্ছি না, আমরা আজ এখানেই থাকব—আজকের দিনটা। তারপর রাত্তিরে আবার গ্রামে ফিরে যাব।
অবাক হয়ে বললাম—তার মানে?
—মানে এই, আমরা চলে গিয়েছি মনে করে রামরামের খুনী আজ রাত্তিরেই আমাদের পেতে আসা ফাদে পা দেবে। অত সোনা মাটির তলায় পড়ে আছে জেনে সে শান্তিতে ঘুমোতে পারবে না। মানুষের চরিত্র যতদূর বুঝেছি তাতে আমার দৃঢ়বিশ্বাস আর দেরি না করে আজ রাতেই সে আসবে। তাকে ধরতে গেলে ওই চালাঘরের পাশে জঙ্গলে আমাদের লুকিয়ে বসে থাকতে হবে।