–আমার এরকম বাইরে থেকেই অভ্যেস, কারো বাড়িতে থাকলে ঘুমোতে পারব। তাছাড়া ভয় কি? এখান থেকে চেঁচিয়ে ডাকলে তো তুমি শুনতে পাবে, তাই না?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
—তবে ঠিক আছে। কাল আমরা চলে যাব, একটা রাত এখানেই কেটে যাবে। যার সঙ্গে এত বন্ধুত্ব—যাকে দিয়ে সম্পর্ক—সেই যখন রইল না—
তারপর একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বিশুঠাকুর বললেন—নাঃ, আর মায়া বাড়াব না—
ঠাকুরের গলাটা যেন বড়ই অভিনয়-অভিনয় ঠেকল। এত দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাহুতাশ করবার লোক ইনি নন। কি ব্যাপার বুঝতে না পেরে চুপ করে রইলাম।
বিশুঠাকুর আবার বললেন—সত্যি, মানুষের কি কপাল! টাকা পয়সা তো মেঝে খুঁড়ে নিয়ে গেলই, গ্রামের কালীমন্দিরটাও আর হল না—
ভিড়ের মধ্যে সামান্য গুঞ্জন চলছিল, হঠাৎ তা থেমে গেল। সবাই নতুন কথা শুনে বিশুঠাকুরের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
শ্রীদাম ঘোষ বলল—আজ্ঞে, এ কালীমন্দিরের কথাটা কি বললেন, ঠিক বুঝলাম না তো?
—কেন তোমরা জান না? রামরাম ঠিক করেছিল গ্রামে বিরাট কালীমন্দির প্রতিষ্ঠা করবে। স্বপ্নে আদেশ পেয়েছিল দেবীর কাছ থেকে। এজন্য কিছু সোনা কিনে জমিয়ে রেখেছিল বেচারা। সে-সবও হত্যাকারী নিয়ে গেল!
শিবরাম অবাক হয়ে বলল—দাদা সোনা কিনে জমিয়ে রেখেছিল। বলেন কি ঠাকুরমশাই? কই, আমরা তো কিছু জানতাম না
—জানবে কি করে? গোপনে করছিল কাজটা। মন্দির প্রতিষ্ঠা হলে দেখতেই পেতে। গতবার যখন আসি, আমাকে একমুঠো পাকা সোনার গিনি দেখিয়ে ছিল। এ ক’বছরে না জানি আরও কত গিনি জমেছিল। সবই পরের ভোগে চলে গেল। মন্দিরটা হলে তোমাদেরই থাকত। মেঝে খোঁড়ার কথা শুনেই বুঝেছি হত্যাকারী আর কিছু রেখে যায়নি—
ভিড়টা আস্তে আস্তে পাতলা হয়ে এল। এত বড় খবরটা বাড়ি গিয়ে সবাইকে জানাতে হবে তো!
শিবরামও শেষপর্যন্ত আমাদের প্রণাম করে উঠে পড়ল।-লণ্ঠনটা রইল। ঠাকুরমশাই, তেল ভরা আছে।
হঠাৎ পেছন থেকে বিশুঠাকুর তাকে ডাকলেন—শিবরাম, শোনো।
—আজ্ঞে?
—দুধটা তুমি নিজে দিয়ে যেয়ো, কারো হাত দিয়ে পাঠিয়ো না—আর—
শিবরাম বিনীত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।
–রামরামের কুকুর কেতুর গায়ের রঙ কি ছিল বলতে পার? লাল?
একটু বিস্মিত হয়ে শিবরাম বলল—আজ্ঞে না, কালো, মিশমিশে কালো। কেন। বলুন তো?
—নাঃ, এমনি মনে হল তাই জিজ্ঞাসা করলাম। আচ্ছা, তুমি যাও এখন!
শিবরাম চলে যেতেই চারদিকে নৈশ স্তব্ধতা যেন প্রকট হয়ে উঠল। বিবি ডাকছে জঙ্গলে, বাশবনে অদ্ভুত শব্দ করে বাঁশ দুলছে। মাথার ওপরে কেবল একটুখানি খোলা আকাশ দেখা যায়। অজস্র নক্ষত্র ফুটেছে কালো রাত্রির পটে। আবহাওয়া বেশ সুন্দর, তেমনি গরমও নেই, আবার ঠাণ্ডাও নয়।
বিশ্বেশ্বর ভট্টাচার্যের গলা শুনতে পেলাম রাত্রির নির্জনতার মধ্যে বেজে উঠেছে, আস্তে আস্তে স্পষ্ট উচ্চারণে বলছেন—অহনাহনি ভূতানি গচ্ছত্তিহ যমালয়ম, শেষাঃ স্থাবরমিচ্ছত্তি কিমাশ্চর্যমতঃপরম!
বললাম—মহাভারত?
–হ্যাঁ। বকরূপী ধর্মের সঙ্গে যুধিষ্ঠিরের সংলাপ। প্রত্যেক দিনই পৃথিবীতে শতশত মানুষ মরছে, কেউ পার্থিব সম্পদ বেঁচেকা বেঁধে সঙ্গে নিয়ে যেতে পারছে না। তবু যারা বেঁচে আছে তারা ভাবছে তারা বুঝি চিরকালই বেঁচে থাকবে।
—কিন্তু সবাই এই সার কথা বুঝে সন্ন্যাসী হয়ে গেলে জগৎসংসার কি করে চলবে ঠাকুরমশাই?
—সবাই সন্ন্যাসী হবে কেন? গৃহী কি সৎ হতে পারে না? অনাসক্ত হতে পারে? কিসের সম্পত্তি আর ঐশ্বর্য আর ক্ষমতা নিয়ে অহঙ্কার? জান তো, মা কুরু ধনজনযৌবনগর্বং, নিমেষে। হরতি কালং সর্বং? যদি সম্পদ সংগ্রহ করতে হয়, তাহলে অপরের জন্য করো—মহাকাল সব এক নিমেষে হরণ করতে পারে।
বললাম—যেমন ঘোষালমশাই গ্রামের লোকদের ভাল হবে বলে মন্দির প্রতিষ্ঠার জন্য সোনা জমিয়েছিলেন?
বিশুঠাকুর একমুহূর্ত আমার দিকে রহস্যময় চোখে তাকিয়ে রইলেন, তার ঠোটের কোণে সূক্ষ্ম হাসির রেখা। তারপর চোখ সরিয়ে নিয়ে হালকা গলায় বললেন-রামরাম কোনোদিনই মন্দির প্রতিষ্ঠার জন্য দেবীর আদেশ পায়নি, তার কোন সোনাও জমানো ছিল না।
বিস্মিত হয়ে বললাম—তার মানে? আপনি যে সবাইকে বললেন নিজের চোখে একমুঠো গিনি দেখে গিয়েছেন–
মিথ্যে কথা বলেছি।
—সে কি! কেন?
—যে সোনা আমার কল্পনায় ছাড়া কোথাও ছিল না, কাজেই হত্যাকারী নিশ্চয় তা পায়নি। যা নেই তা আর পাবে কি করে? কিন্তু আমার এই কথাটা এখুনি গ্রামের মধ্যে প্রচার হয়ে যাবে।
হত্যাকারীও গ্রামের লোক, রামরামের পরিচিত লোক—নইলে প্রথমত সে রামরামের লুকোনো টাকার কথা জানতে পারত না, দ্বিতীয়ত তাকে দেখেই খুনের রাত্রে কুকুরটা চেচাত এবং আক্রমণ করত। সম্ভবত একটু আগে এখানে যে ভিড় জমেছিল, তার মধ্যে সে দাঁড়িয়েছিল। এখন এই সোনার কথা শুনে সে মনে করবে এটা এখনও এ ঘরের মেঝেতেই কোথাও মাটির তলায় পোতা রয়েছে। সোনার লোভ বড় লোভ। আমার বিশ্বাস, এ ভুল শুধরে নিতে সে আবার এখানে আসবে।
শুনে বিশেষ ভরসা হল না। বাঁশবনের ধারে এই চালাঘরে আমরা দুটি প্রাণী। রাত্তিরে যদি রামরামের হত্যাকারী আবার আসে তাহলে আমি অন্তত খুব আনন্দ পাব না।
বললাম—কবে আসবে?
বিশুঠাকুর হেসে বললেন—ভয় নেই, আজ আসবে না। সে বোকা নয়, সে জানে তার হাতে অঢেল সময় রয়েছে। আমরা কাল চলে গেলে সে যে কোনোদিন এসে ধীরেসুস্থে কাজ শেষ করে যাবার কথা ভাববে। একজন অসতর্ক মানুষকে খুন করা সোজা, কিন্তু ধুনী জ্বালিয়ে জেগে, থাকা দু-জন মানুষকে আক্রমণ করা সহজ নয়— আর খামোকা করবেই বা কেন, যখন পরে নিরুপদ্রবে কাজটা সারা যেতে পারে?