—আমার অভ্যেস আছে।
আমার সংক্ষিপ্ত উত্তরে বিশুঠাকুর একবার আমার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, তারপর বললেন—চল তাহলে। অখ্যাততর একটি স্টেশনে নেমে মাইলছয়েক হেঁটে ঘোর সন্ধেবেলা রামরাম ঘোষালের গ্রামে পৌঁছনো গেল। বিশুঠাকুর আগে দু-একবার এ গ্রামে এসেছেন। তিনি হনহন করে হেঁটে গ্রামের একেবারে শেষপ্রান্তে একটা বড় আটচালা বাড়ির সামনে দাঁড়ালেন। মাঝখানে উঠোন ঘিরে গায়ে গায়ে লাগা অনেকগুলো ঘর, উঠোনে তুলসীমঞ্চ। ঘরে ঘরে আলো জ্বালার উদ্যোগ চলছে, কয়েকটি শিশুর কলরব শোনা যাচ্ছে। কিন্তু সবমিলিয়ে বাড়ির পরিবেশে একটা শোকের বিষণ্ণতা পরিব্যপ্ত হয়ে আছে। বিশুঠাকুর আমার হাত ধরে উঠোনে এসে দাঁড়ালেন।
গৃহস্বামী এগিয়ে এসে অতিথিকে আপ্যায়ন না করলে অতিথির পক্ষে দাঁড়িয়ে থাকাটা বড় অস্বস্তিকর হয়ে পড়ে। এ বাড়ির কর্তা এখন কে জানি না, কাজেই আমরা চুপ করে দাঁড়িয়েই রইলাম।
মিনিটদশেক পরে উঠোনের ওধারের একটা ঘর থেকে প্রদীপহাতে এক বিষণ্ণমূর্তি মহিলা বেরিয়ে তুলসীতলায় আসতে গিয়ে আমাদের দেখে থমকে দাঁড়িয়ে বললেনকে? কে ওখানে?
বিশুঠাকুর দু-পা এগিয়ে গিয়ে বললেন—বৌমা, আমি বিশ্বেশ্বর ভট্টাচার্য। চিনতে পারছ? রামরাম থাকতে আমি এসেছি কয়েকবার
মহিলাটি একমুহূর্ত নীরব থাকবার পর চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন। তার কান্নার শব্দে চারদিকের ঘর থেকে এতক্ষণে অনেকে বেরিয়ে এল। বেশ কিছুক্ষণ একটা মিশ্র কোলাহল চলবার পর আমরা দাওয়ায় বসবার আসন পেলাম।
একঘণ্টা পর।
বিশুঠাকুর এসেছেন শুনে গ্রামের অনেকে জড়ো হয়েছে রামরাম ঘোষালের বাড়ি। তালপাতার চাটাইতে বিশুঠাকুর বেশ ঋজু হয়ে বসে আছেন। রামরামের ছোটভাই শিবরাম চোখে জল নিয়ে হাতজোড় করে ধরা গলায় বলছে—ঠাকুরমশাই, কে একাজ করেছে জানি না কিন্তু যেই করুক, সে ভুল করেছে। দাদা আমার শিবতুল্য মানুষ ছিলেন, ব্যবসা করতেন বটে, কিন্তু টাকাকড়ির ওপর কোন লোভ ছিল না। কত লোকের পাওনা ছেড়ে দিয়েছেন, কত লোকের কন্যাদায় উদ্ধার করেছেন। এ অঞ্চলের সবাই জানত বিপদে পড়ে রামঠাকুরের কাছে গেলে খালিহাতে ফিরতে হবে না। এত পয়সা উপার্জন করতেন, কিন্তু নিজে পরতেন একটা খাটো ধুতি, সারাদিনের শেষে খেতেন একমুঠো আতপচাল সেদ্ধ। আমার বিশ্বাস, হত্যাকারী চাইলে দাদা টাকাপয়সা সবই বের করে দিতেন, খুন করবার দরকার হত না। সবই ভাগ্য—
বিশুঠাকুর জিজ্ঞাসা করলেন পুলিশ কি বলছে? শিবরাম উত্তর দেবার আগেই ভিড়ের মধ্য থেকে একজন কে বলে উঠল—পুলিশ বরাবর যা বলে। খুনের পরদিন সকালে খবর দেওয়া হয়েছে, পুলিশ এসেছে বিকেলে। কি ঝামেলা ভাবুন তো! আবার দারোগ বলে দিয়েছিল—পুলিশ পৌঁছনোর আগে যেন মৃতদেহ সৎকার না করা হয়। সেই দেহ নিয়ে পরদিন রাত বারোটা অবধি সবাই বসে। এদিকে পুলিশের কি হম্বিতম্বি—গ্রামসুদ্ধ লোককে ফাঁসি দেয় আর কি! তারপর পুলিশও চলে গেল, সবকিছু মিটে গেল। খুনি আর ধরা পড়েছে।
বিশুঠাকুর বিষণ্ণতা মাখানো গলায় বললেন—ঠিকই। পুলিশের অপদার্থতা আর কারও জানতে বাকি নেই, খুনীকে তারা ধরতে পারবে বলে আমারও বিশ্বাস হয় না। আহা, রামরাম এমন বেঘোরে মারা যাবে স্বপ্নেও ভাবিনি। নাং, এ খুনের কিনারা কিছু হবে না—
আমি একটু অবাক হয়ে বিশুঠাকুরের মুখের দিকে তাকালাম। এই আজই কয়েকঘণ্টা আগে না—ব্যাপার কি? কিন্তু বিশুঠাকুর সত্যিই যেন কেমন হতাশ আর হালছাড়া ভঙ্গিতে বসে রয়েছেন, মুখে শোকের ছায়া। আসলে বন্ধুর মৃত্যুতে বুড়োমানুষ হয়ত রেগে গিয়ে ওসব কথা তখন বলেছিলেন, সত্যিই তো—কি করে আর এখন ধরা যাবে হত্যাকারীকে?
একজন দীর্ঘদেহ শ্যামবর্ণ লোক ভিড়ের থেকে একটু আলাদা হয়ে দাওয়ার একপ্রান্তে বসে সবার কথা শুনছিল। গ্রাম্য মানুষদের থেকে তার ব্যক্তিত্বকে কিছুটা আলাদা করে বোঝা যায়। অন্য সবাই বেশির ভাগই খালিগায়ে এসেছে, কেবল এ লোকটির গায়ে হাফহাতা নীল শার্ট। এসব শহুরে ধাঁচ লোকটা পেল কোথায় তা ভাবছি, এমন সময় লোকটা বলে উঠল-খুনের কিনারা হবে না বলছেন? ভাবলেও খারাপ লাগে, রামজ্যাঠার মত লোক—খুনীর শাস্তি না হলে তার আত্মা শাস্তি পাবে না। কিছুই কি করার নেই?
সে কথার উত্তর না দিয়ে বিশুঠাকুর লোকটির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন—তুমি কে?
লোকটি যেন একটু থতমত খেয়ে বলল—আজ্ঞে, আমি হরিপদ।
–রামরামের ভাইপো?
—আজ্ঞে না, ওঁকে ছোটবেলা থেকেই জ্যাঠামশাই বলে ডাকি। উনি আমার বাবার বন্ধু ছিলেন।
—গতবার এসে তো তোমাকে দেখেছি বলে মনে হয় না—
হরিপদ বলল—ঠিকই। আমি মাঝে প্রায় পনেরো বছর গ্রামে ছিলাম না। বাইরে চাকরি . করতাম, সম্প্রতি ফিরে গ্রামে বসেছি।
—চাকরি ছাড়লে কেন?
বিশুকুরের জেরায় লোকটি স্পষ্টত বেশ অস্বস্তি বোধ করছে। সে বলল শরীরটা ভাল যাচ্ছে না, চাকরির ধকল পোষাল না। শরীর একটু ভাল বোধ করলে হয়ত আবার চলে যাব–
বিশুঠাকুর তাকে আর কোন প্রশ্ন করলেন না। উপস্থিত ব্যক্তিদের মধ্যে একটু মাতব্বরমত শ্রীদাম ঘোষ বলল—ঠাকুর যখন এসেছেন, এদের বাড়িতে একটু স্বস্ত্যয়ন করে দিয়ে যান। অপঘাতটা হল তো—বাড়ি ঠাণ্ডা হবে’খন।
সে হবে। কর্তব্য করব বলেই তো এসেছি—
আবার ঠাকুরের দিকে তাকিয়ে দেখলাম। ভারি অদ্ভুত মানুষ তো! সেই দৃঢ় প্রত্যয়ের সুর ফিরে এসেছে গলায়। কর্তব্য! কি কর্তব্যের কথা উনি বলছেন?