চা এল, সঙ্গে নারকেল নাড়ু আর বাড়িতে ভাজা কুচো নিমকি খাওয়ার পর কিশোরীর পকেট থেকে অবশ্যম্ভাবী পাসিং শো-এর প্যাকেটটি বেরুল। সিগারেট ধরিয়ে তারানাথ চোখ; বুজে মৌজ করে টান দিচ্ছে, কিশোরী বলল—আজ বছরকার দিনটা, একটা গল্প না শুনেই ফিরে যাব?
তারানাথ চোখ মেলে হেসে বলল—তোমরা দুটিতে যখন এসোছ, গল্প না শুনে ফিরবে না জানি। কি রকম গল্প চাই?
—আজ আমাদের কোনো বায়না নেই। আপনি যা বলবেন—
কিছুক্ষণ তারানাথ চুপ। বোধহয় মনে মনে গল্পটাকে গুছিয়ে নেবার কাজ চলছে। সিগারেটে শেষ টান দিয়ে অ্যাশট্রে হিসেবে ব্যবহৃত একটা নারকেলের মালায় গুজে তারানাথ বলতে শুরু করল—বীরভূমের একটা রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে বসে আছি। লুপ লাইনের অখ্যাত, গেয়ো স্টেশন। সাহেবগঞ্জ লোকাল ধরে হাওড়া আসব, তা সে ট্রেন শুনলাম দেড়ঘণ্টা লেট। কোথাও একটা খাবারের দোকানও নেই যে এককাপ চা খাব। একটা বিড়ি ধরিয়ে পায়চারী করছি, দেখি প্ল্যাটফর্মের একেবারে শেষ প্রান্তে একটা ইটের পাজার ওপর একজন বিশাল চেহারার লোক চুপ করে বসে আছে। পোশাক খুবই সাধারণ, খাটো ধুতির ওপর একটা ফতুয়া গোছের জামা, পায়ে বহু পুরনো একজোড়া চটি। মাথায় অযত্নলালিত বাকড়া চুল। কিন্তু লোকটার ঋজু বসবার ভঙ্গিতে আর চোখের দৃষ্টিতে এক আশ্চর্য ব্যক্তিত্বের ছাপ রয়েছে, বার বার তাকিয়ে দেখতে হয়।
আমাকে অনেকক্ষণ একা কাটাতে হবে, কাজেই আলাপ জমাবার উদ্দেশ্যে ইটের পাজার একপাশে বসে পড়ে জিজ্ঞাসা করলাম—সাহেবগঞ্জ লোকাল ধরবেন বুঝি?
আমার দিকে না তাকিয়েই লোকটা বলল—হ্যাঁ।
—সে ট্রেন তো শুনলাম দেড়ঘণ্টা দেরিতে আসছে।
—হ্যাঁ।
দু-বার এরকম একাক্ষরী উত্তর দেবার পর লোকটি এবার আমার দিকে তাকাল। বেশ বুদ্ধিদীপ্ত চোখে আমার আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বলল-গুরুর দর্শনলাভ ঘটেছে?
হেসে বললাম—কি করে বুঝলেন?
লোকটিও সামান্য হেসে বলল—হাত গুনতে হয় না, তোমার গেরুয়া আর রুদ্রাক্ষের মালা দেখেই বলা যায় তুমি কোন পথের পথিক।
—আর গুরুর ব্যাপারটা?
—গুরুর কৃপা না পেলে চোখে জ্যোতি ফোটে না। তোমার চোখে সেই জ্যোতি রয়েছে। তুমি বলছি বলে রাগ করছ না তো? তুমি আমার চেয়ে অনেক ছোট–
সবিনয়ে বললাম—না না, আমাকে তুমি’-ই বলবেন।
—আমার বয়েস কত মনে হয়?
ভাল করে তাকিয়ে দেখে বললাম—বছর পঞ্চাশেক হবে, না কি?
–-আমার এই বাহাত্তর চলছে, সামনের চৈত্রে তিয়াত্তর হবে।
অবাক হয়ে বললাম—বলেন কি। যাঃ, তা কি করে হতে পারে? আপনার তো একটা চুলও পাকেনি দেখছি—
–পাকবেও না। যেদিন যাবার হবে এইভাবেই চলে যাব।
আমি উঠে তার পায়ের ধুলো নিয়ে বললাম—আপনি নিশ্চয় সিদ্ধপুরুষ, অনেক ভাগ্যে আপনার দেখা পেলাম। আমাকে আশীর্বাদ করুন।
লোকটি সজ্জন, আমি পায়ে হাত দিতে সঙ্কুচিত হয়ে বললেন—আরে আরে! পায়ে হাত দিচ্ছ কেন? আমি সিদ্ধপুরুষটুরুষ কিছু নইরে ভাই, নিয়মিত প্রাণায়াম করি— তাতেই শরীরটা তৈরি হয়ে গিয়েছে আর কি। জরার আক্রমণ কিছুদিন ঠেকিয়ে রাখতে পারব।
ইটের পাঁজার ওপর লোকটির পাশে জমিয়ে বসলাম। একটু একটু করে আলাপও হয়ে গেল। তার নাম বিশ্বেশ্বর ভট্টাচার্য, লোকে বিশুঠাকুর বলে ডাকে এককালে মুর্শিদাবাদের কোন গ্রামে বাড়ি ছিল, এখন কিছু নেই। এইরকম ঘুরে ঘুরে বেড়ান, কোথাও কোনো বটতলায় বা মন্দিরে আশ্রয় নেন। সাধুসন্তের প্রতি গ্রামের মানুষের আকর্ষণ চিরকালের—তারা দেখতে এসে কলা মুলো যা দেয় তাতেই একটা পেট চলে যায়।
জিজ্ঞাসা করলাম—এখন যাচ্ছেন কোথায়?
উনি একটু চুপ করে থেকে বললেন—বেশিদূর নয়, এই কয়েকটা ইস্টিশন পরেই আমার এক গুরুভাইয়ের বাড়ি। একসঙ্গে দীক্ষা নিয়ে দুজনে কিছুদিন সাধনা করেছিলাম। পরে সে অবশ্য বিয়েথাওয়া করে সংসারী হয়—ধানের ব্যবসা করে কিছু টাকাও করেছিল, সেটাই তার কাল হল শেষ অবধি–
নড়ে বসে বললাম—কি রকম?
বিশুঠাকুর বললেন—আমার সেই বন্ধু, রামরাম ঘোষাল, দিন দশবারো আগে খুন হয়েছে।
—সেকি খুন! কেন?
–রামরামের কিছু টাকাপয়সা হয়েছিল এ খবর অনেকেই জানত। নিজের বসতবাড়ি থেকে একটু দূরে বাঁশঝাড়ের পেছনে রামরাম একখানা ঘর তুলেছিল, সেখানে রাত্তিরে গিয়ে সাধনভজন করবার চেষ্টা করত। গৃহী হয়েও এ অভ্যেসটা ছাড়তে পারেনি। এই ঘরেরই মাটির মেঝেতে টাকা পুঁতে রেখেছিল রামরাম। তাকে মেরে মাটি খুঁড়ে সবকিছু নিয়ে চলে গিয়েছে।
—কে করল এ কাজ?
বিশুঠাকুর বললেন—জানি না। তবে যে করেছে তাকে শাস্তি পেতেই হবে। যে কাঠায় মাপ, সে কাঠায় শোধ, বুঝলে?
ঠাকুরের গলার স্বরে একটু অবাক হলাম। এ শুধু প্রিয় বন্ধুর অক্ষম হাহাকার নয়, এ কথার পেছনে দৃঢ় প্রত্যয় লুকিয়ে রয়েছে। কিন্তু অজ্ঞাত হত্যাকারীর বিরুদ্ধে বিশুঠাকুর কিইবা করতে পারেন তা বুঝলাম না।
-তুমি কোথায় চলেছ? হেসে বললাম—কোথাও না। মানে, কোনো ঠিক নেই। আর কি। বাড়িতে ভাল লাগে না, তাই ঘুরে ঘুরে বেড়াই, আর সাধুসন্নাসীর দেখা পেলে তাদের সঙ্গলাভের চেষ্টা করি। এই যেমন এখন ইচ্ছে করছে আপনার সঙ্গে থাকি—
বিশুঠাকুর এই প্রথম হাসলেন, বললেন—আমার সঙ্গে থাকতে চাও? বেশ, চল— আমার কোনো আপত্তি নেই। খাওয়াদাওয়া কিন্তু আমার যা জুটবে তোমারও তাই, আবার নাও জুটতে পারে, চলবে তো?