বলে কি সুবালা! বিয়ে তো আর হচ্ছেই না, কিন্তু এতে ব্যাপার অন্যদিকে অনেকদূর গড়িয়ে যেতে পারে। বিজয়বাবু ধমক দিয়ে বললেন—আঃ, কি বলছিস্ চুপ কর।
কাকে কি বলা! সুবালা কালনাগিনীর মত ফুলছে। বলছে—টাকার জন্য খুন। করেছিলি, না? দাদাকে মেরে শান্তি হয়নি। সম্পত্তি পাবার জন্য আমাকে আর খোকাকে পাহাড় থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলি। বেশ! কিন্তু এবার তোকে কে বাঁচাবে?
সনাতনবাবুর মুখ সাদা হয়ে গিয়েছে। অবাস্তব, অসম্ভব বিভীষিকা দেখলে মানুষের মুখ যেমন হয়। তিনি অস্ফুট স্বরে বলে উঠলেন—বৌদি।
সেই মুহূর্তেই সুবালা টলতে টলতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। বিজয়বাবু স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, অমর ভায বারবার বলছেন—চলে যান, সনাতনবাবু, আপনি এক্ষুনি এখান থেকে চলে যান। আমি তাকে থামিয়ে দিয়ে সনাতনবাবুর সামনে গিয়ে বললাম—বৌদি কে?
সনাতনবাবু ঠকঠক করে কাপছেন। বললেন—অ্যাঁ?
আমি আবার বললাম—বৌদি বলে কাকে ডাকলেন? কাকে ঠেলে ফেলে দিয়েছিলেন পাহাড় থেকে?
সনাতনবাবু আর কোনোদিন কোন কথা বলার সুযোগ পাননি। আমার পেছন থেকে হঠাৎ বিজয়বাবু ‘ধর ধর করে চিৎকার করে উঠলেন। আমি চমকে পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখি সুবালা একটা বিরাট বঁটি নিয়ে ঘরে ঢুকছে। তার কাপড় প্রায় খুলে গিয়েছে, চোখে খুনীর দৃষ্টি। আরো পেছনে দৌড়ে আসছেন মহিলারা। ব্যাপারটা চোখের নিমেষে ঘটে গেল। অমরবাবু খাট থেকে নেমে, বা আমি আর বিজয়বাবু এগিয়ে গিয়ে বাধা দেবার আগেই সুবালা ঝড়ের বেগে দৌড়ে এসে সনাতন মুখুজ্জের গলায় বঁটিটা বসিয়ে দিল। বিকৃত একটা শব্দ করে সনাতনবাবু পড়ে গেলেন। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটল। সুবালা পড়ে গেল অজ্ঞান হয়ে।
মিনিট দশেক পরে মোড়ের ডাক্তারখানা থেকে যখন ডাক্তার নিয়ে ফিরে এলাম, তখন আর সনাতনবাবুর দেহে প্রাণ নেই। ঘণ্টা দুই পরে সুবালার জ্ঞান ফিরেছিল। কিন্তু এতসব ঘটনা তার কিছুই মনে নেই। সম্পূর্ণ স্বাভাবিক।
সনাতনবাবুর ছেলে কেস চেপে দেবার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু পুলিশ ছাড়েনি। পুলিশ সুবালার বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ আনে। কিন্তু জজ বুদ্ধিমান। এ খুনের কোনো মোটিভ নেই, তাছাড়া আসামীপক্ষ থেকে বলা হয়েছিল মেয়ে পাগল। আমার আর অমর ভচ্চাযের সাক্ষ্যেও কাজ হয়েছিল। সুবালা খালাস পেয়ে যায়।
গতজন্মে টাকার লোভে বিধবা সুবালা আর তার সন্তানকে হত্যা করেছিল সনাতন! সেই সম্পত্তি পেয়েই জব্বলপুরে ব্যবসা ফেঁদেছিল সে। এদিকে সুবালা কোলকাতায় বিজয় চাটুজ্জের মেয়ে হয়ে জন্মগ্রহণ করেছে। ভগবানের মার বড় সাংঘাতিক মার। কোথা থেকে সনাতন মুখুজ্জেকে এসে শাস্তি নিয়ে যেতে হল। নিজের জন্য অতটা নয়—কিন্তু তার সন্তানের মৃত্যুর কথা ভুলতে পারেনি সুবালা। সনাতনকে দেখামাত্র দপ করে জ্বলে উঠেছিল জন্মান্তরের স্মৃতি।
তারানাথ থামল। অন্যদিন গল্পের শেষে কিশোরী যা হোক একটা টিপ্পনী কাটে। আজ সেও চুপ করে বসে রইল। বাইরে ল্যাম্পপোস্টে আলো জ্বলে উঠেছে। ঘরের মধ্যে কেমন একটা বিষণ্ণতা। তারানাথও আর কোন কথা বলছে না।
শেষে আমিই স্তব্ধতা ভেঙে বললাম—আজ যাই। আর একদিন আসব।
০৯. পুজোর পর অফিস খুলেছে
পুজোর পর অফিস খুলেছে। দশ-বারোদিন কুঁড়েমি করার পর কাজে আর মন বসে না, সকালে উঠে জোর করে অফিসের জন্য তৈরি হতে হয়। এতদিনেও বেশ পোক্ত চাকরিজীবী হতে পারলাম না। আমার বিশ্বাস মানুষের জীবনটা প্রধানত অবকাশ-যাপনের জন্যই, তবে অবসর সময়ে একটা চাকরি করলে ক্ষতি নেই। কিন্তু বর্তমান পৃথিবীর দাবী এত বেশি যে, চাকরিই প্রধান হয়ে উঠেছে, অবকাশটা গৌণ। অথচ মানবসভ্যতার শ্রেষ্ঠ অবদান যা—যেমন সাহিত্য, শিল্প, ভাস্কর্য—সবই তো অবকাশের ফসল। একমাত্র বানে পেটেন্ট অফিসে কাজ করতে করতে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদের আবিষ্কার ছাড়া চাকরি করে কে কবে অমর হয়েছে?
ছুটির পর বাড়ি ফিরে চা খেতে খেতে এইসব উচ্চমার্গের চিন্তা করছিলাম। ক্রমে যখন ধারণা হয়ে এসেছে যে, চাকরি না করলে আমিও জগতে অমর কীর্তি রেখে যেতে পারতাম, (ক্লাস সেভেনে যখন পড়ি, আমার লেখা কবিতা পড়ে থার্ড পণ্ডিত মশাই যে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন সেটা তো আর মিথ্যে নয়! কেউ কেউ যে রবি ঠাকুরের কবিতার সঙ্গে মিল দেখতে পেয়েছিল, সেটা কেবল নিন্দুকগুলা খাইতে পায়না বলিয়াই–) সেই সময়ে বাইরে থেকে কিশোরীর হাক শোনা গেল। বেরিয়ে বললাম—ব্যাপার কি?
-এই যে, ফিরেছ দেখছি। আজ আর তাসের আড্ডায় যেতে ইচ্ছে করছে না। চল, তারানাথকে বিজয়ার প্রণাম করে আসি
শার্টটা গায়ে চাপিয়ে কিশোরীর সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম। তারানাথ রাবড়ি খেতে ভালবাসে, কিন্তু সম্প্রতি তার যা আর্থিক অবস্থা তাতে রাবড়ি খাওয়া চলে না। কিশোরী আর আমি পকেট হাতড়ে যা বের করলাম, তা দিয়ে তালতলার চেনা হিন্দুস্থানীর দোকান থেকে সেরখানেক রাবড়ি কিনে নেওয়া গেল।
আমাদের দেখে তারানাথের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, বলল—বৌ আর ছেলেপিলেরা। ছাড়া এই তোমরাই যা বিজয়া করতে এলে এবার! এত যে জানাশোনা লোক ছিল, তারা গেল কোথায় বল দেখি?
রাবড়ি পেয়ে তারানাথ খুব খুশি, ওঃ এ তো প্রায় সেরখানেক হবেই। অনেকদিন পর পেট ভরে রাবড়ি খাব। বোসো তোমরা, চা বলে আসি-–