বললাম—কি ব্যাপার? গৃহিণী পুত্রমুখ দর্শন করবেন নাকি?
-দূর। আপনার যেমন সব কথা! এই বয়েসে—যাকগে। কথা হচ্ছে এই আমাদের বিজয় চাটুজ্জের মেয়ের বিয়ে বোধ হয় লাগল।
-কার, সুবালার?
হ্যাঁ। আগামী পরশু পাত্রের বাবা দেখতে আসছেন জব্বলপুর থেকে। প্রবাসী বাঙালী। পাত্রও সেখানেই ব্যবসা করে। বিরাট অবস্থা। মেয়ে সুন্দরী শুনে দেখতে আসছে। নইলে বিজয়ের যা আর্থিক সঙ্গতি, এরকম ঘরে তারা ছেলের বিয়ে দেবার ব্যবস্থা করতো না। আপনিও আসুন না ওদিন। বিজয় আমাকে বলেছিল আপনাকে নিয়ে যেতে। একটা শুভদিন—আপনার মত সদব্রাহ্মণ উপস্থিত থাকলে সুবালার মঙ্গল হবে।
মেয়ে দেখার দিন বিজয় চাটুজ্জের বাড়ি গেলাম অমরের সঙ্গে। এসব সামাজিক উৎসব আমার ভালোই লাগে। তারপর মেয়ে দেখানোর ব্যাপার, ভালো খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা থাকবে নিশ্চয়ই। আমি ভোজন রসিক চিরদিনই। ধুতি-চাদর চাপিয়ে বিকেলে গিয়ে হাজির হলাম।
তখনও ছেলের বাবা এসে পৌছান নি। বিজয়বাবু আমাদের আদর করে নিয়ে বৈঠকখানায় বসালেন। তামাক এল, চা-খাবার এল। বিজয়বাবু একবার সুবালাকে ডেকে এনে প্রণাম করিয়ে নিয়ে গেলেন। সুবালা মাথায় হঠাৎ যেন অনেকখানি লম্বা হয়ে গিয়েছে। চোখ-মুখ যেন তুলি দিয়ে আঁকা। সত্যি সুন্দরী বটে। মাথায় হাত দিয়ে প্রাণভরে আশীর্বাদ করলাম—সুখী হও মা।
জীবনে এমন ব্যর্থ আশীর্বাদ আর করিনি।
বিজয় চাটুজ্জে বললেন—ঠাকুরমশায় কিন্তু আজ রাত্তিরে এখানেই খেয়ে যাবেন। মাংস চলে তো?
খুব চলে। আমি ঘন্টানাড়া পুরুত বামুন নই।
সবারই মন বেশ ভাল। বিজয়বাবুর মনের আনন্দ কিছুটা বাইরে বেরিয়ে আসছে। কেনই বা হবে না? বড়লোকের ঘরে মেয়ে বিয়ে দিতে চলেছেন। বিয়ে প্রায় ঠিকই বলতে গেলে। পাত্রের কে এক আত্মীয় মেয়ে দেখে গিয়ে ওখানে দারুণ প্রশংসা করেছেন। আজ বাবা দেখে গেলেই পাকাপাকি হয়ে যায়।
সন্ধ্যে ঠিক সাতটায় দরজার কড়া নড়ে উঠল। বিজয় ব্যস্ত হয়ে বেরিয়ে গিয়ে একটু পরেই এক দোহারা চেহারার সুপুরুষ প্রৌঢ় ভদ্রলোককে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। আলাপ করিয়ে দিয়ে বিজয়বাবু বললেন—ইনি হচ্ছেন সনাতন মুখোপাধ্যায়, পাত্রের বাবা। আমরা নমস্কার করলাম। সনাতনবাবু আমাকে প্রণাম করার ধার দিয়েও গেলেন না। অর্থ থাকলেও অনেক ধনী ব্যক্তির ব্যবহারে একটা নম্রতা থাকে। ইনি সে দলের নন। বেশ জবরদস্ত লোক। আমাদের নমস্কারের উত্তরে একটা দায়সারা প্রতিনমস্কার করেই তাড়া দিয়ে বললেন—চাটুজ্জেমশাই মেয়েকে আনুন। আমার হাতে বেশি সময় নেই। এখুনি আবার উঠতে হবে। কোলকাতায় এসেছিলাম ব্যবসার একটা জরুরি কাজে। ভাবলাম এলাম যখন একবার দেখেই যাই। নইলে এমনিতে তো আর বড় একটা আসা হয়ে ওঠে না।
এমন দু’চারটি কথায় ভদ্রলোক বেশ স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিলেন তার আর বিজয়বাবুর মধ্যে অবস্থার বিস্তর প্রভেদ। বুঝিয়ে দিলেন যে তিনি নেহাত ব্যবসার কাজে আসতে হয়েছিল বলেই দয়া করে মেয়ে দেখে যাচ্ছেন। বুঝলাম বিয়ে হয়ত হবে, কিন্তু কুটুম্বের দিক দিয়ে বিজয়বাবুর বিশেষ সুখ হবে না। কিন্তু কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার অত সম্মানজ্ঞান থাকলে চলে না। বিজয়বাবু তাড়াতাড়ি করে ভেতরে গেলেন মেয়েকে আনবার কথা বলতে। আমরা মুখ নিচু করে নীরবে বসে রইলাম। এক একজন লোক আছে, যাদের সামনে কিছুতেই আড্ডা জমানো যায় না। সনাতন মুখোপাধ্যায় সেইরকম লোক। একটু বাদেই ভেতর থেকে খাবার এল। মেয়েদের নিজের হাতে তৈরি খাবার। সনাতনবাবু সে-সব স্পর্শও করলেন না। কেবল চা খেলেন এককাপ। আর অনর্গল মেয়ে দেখানোর জন্য তাড়া দিতে লাগলেন। বিজয়বাবু মুক্তকচ্ছ হয়ে বারবার সে তাড়া বাড়ির ভেতরে পৌঁছে দিয়ে আসতে লাগলেন। বস্তুত এমন অভব্য মানুষ খুব কমই দেখেছি।
এইবার ঘটল আসল ঘটনা, যে কাহিনী বলবার জন্য বসেছি।
একটু বাদেই যে একটা বিরাট কিছু ঘটতে চলেছে তা আমরা ঘূণাক্ষরেও জানতে পারিনি। বেশ সুন্দর পরিবেশ। একটি বিয়ের প্রাককথন হবে, কিছু বাদে একটি ভোজের আভাসও রয়েছে। কে জানত কি ভয়াবহ ব্যাপার ঘটতে চলেছে আর কয়েক মিনিটের মধ্যে।
ভেতরবাড়ির দিকে চুড়ির শব্দ হতে বিজয়বাবু উঠে গিয়ে সুবালাকে হাত ধরে ঘরের ভেতরে নিয়ে এলেন। আমি বেশ ভাল করে তখন তার মুখ দেখেছিলাম। হলপ করে বলতে পারি, সে মুখে তখন কোনো অস্বাভাবিকতা বা পাগলামির চিহ্নমাত্র ছিল না। আমি সুবালাকে বসতে জায়গা করে দেব বলে উঠে সরে যাচ্ছি, অমরনাথও সরে বসবার উদ্যোগ করেছে, হঠাৎ কেমন একটা অদ্ভুত আওয়াজে মুখ তুলে তাকিয়েই পাথর হয়ে গেলাম।
সুবালার চোখ বিস্ফারিত, জিঘাংসু উন্মাদের মত সে তাকিয়ে কাছে সনাতন মুখুজ্জের দিকে। সনাতনবাবুও বিস্মিত হয়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন। সুবালার সমস্ত শরীরের পেশী শক্ত হয়ে গিয়েছে। চোখ তীব্র ক্রোধে জ্বলে উঠেছে, ঠোটের ভঙ্গি ক্ষিপ্ত।
বিজয়বাবু ভয় পেয়ে কি যেন বলতে যাচ্ছিলেন। তার মনের অবস্থা সহজেই অনুমান করা যায়। অনেক দিন মেয়ে এমন করেনি। একেবারে সেরে গিয়েছে, এই ভরসায় তার বিয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন। আজ এত বছর পরে আবার সুবালার এমন। হবে কে জানত! তিনি বোধহয় কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই ঘরের মধ্যে সুবালার তীব্র আক্রোশপূর্ণ গলা ছড়িয়ে পড়ল—ওই! ওই লোকটাই আমার খোকাকে মেরে ফেলেছে, আমাকে মেরে ফেলেছে।