বললাম, নিজে প্রত্যক্ষ দেখিনি কখনও। গাছপালা থেকে ওষুধ তৈরি হয় দেখেছি, খেলে অসুখ সেরে যায় তাও দেখেছি। কিন্তু যেসব কথা শুনতে পাওয়া যায়—যেমন বশীকরণ, স্তম্ভন—সেসব দেখিনি।
সাধু হেসে উঠে বলল, বশীকরণ ও আবার একটা কঠিন কিছু নাকি? ওর অনেকরকম উপায় আছে। বেশি জটিল প্রক্রিয়ায় যাবার দরকার কি? একটা সোজা উপায় শিখিয়ে দিই, শোন। চেষ্টা করলে তুমিও পারবে–
-–আজ্ঞে কি?
—যে কোন মাসের অমাবস্যা তিথিতে যদি দুপুরবেলা ঘূর্ণিঝড় ওঠে কিংবা জোরালো হাওয়া দেয়, তাহলে সেই হাওয়ায় উড়ে যাওয়া কোন শুকনো গাছের পাতা একটা মন্ত্র বলতে বলতে বা হাতে ধরে ফেলতে হবে। সেই পাতা গুড়ো করে পান বা দুধ বা যাহোক কিছুর সঙ্গে খাইয়ে দিতে পারলে সেই লোক কুকুরের মত তোমার পায়ে পায়ে ঘুরবে। আছে আমার কাছে, দেখবে?
সাধু ঝুপড়ি থেকে একটা শুকনো অশ্বখপাত হাতে করে বেরিয়ে এল, বললভাদ্রমাসের অমাবস্যায় ধরেছিলাম। থাক আমার কাছে, এর গুণ দেখিয়ে দেব–
দিনদুয়েক আগে সাধু একটা বেশ মোটা নিমের ডাল নিয়ে এসেছিল। একদিন সকালে দেখি বসে বসে ছুরি আর দা দিয়ে কেটে তার থেকে একটা পুতুল বানাচ্ছে। নাক, মুখ, চোখ সবসুদ্ধ একটা মানুষের মূর্তি। এদিনও অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, এ দিয়ে কি হবে?
এদিনও সাধু রহস্যময় হেসে বলল, কাজ আছে।
তখনও আমি সাধুর আসল উদ্দেশ্য কিছুই বুঝতে পারিনি। বুঝতে পারলে আর এক মুহুর্তও সেখানে থাকতাম না।
আরো তিনচারদিন কাটল। একদিন বিকেলে আমি রান্নার জন্য কাঠকুটো এক–জায়গায় জড়ো করছি, সাধু এসে কাছে বসল। বলল, তুমি প্রকৃতির সংহার শক্তিতে বিশ্বাস কর?
বললাম, আজ্ঞে, ঠিক বুঝতে পারলাম না।
–প্রকৃতির অনেকরকম শক্তি আছে। যেমন প্রকৃতি আমাদের শস্য দান করে, বাতাস দান করে, বৃষ্টি দান করে—এগুলিতে আমাদের প্রাণ বাঁচে। এগুলি শুভ শক্তি। আবার মহামারী, দুর্ভিক্ষ, বন্যা, যুদ্ধ—এগুলি হল সংহারক শক্তি। এছাড়াও নানা ধরনের অদৃশ্য, অদ্ভুত মারক শক্তি আছে, সাধনার দ্বারা তাদের জাগ্রত করা যায়। যেমন বেতাল জাগানো। বেতাল হচ্ছে এক ধরনের ক্রুর নিষ্ঠুর অপশক্তি, তার মারক ক্ষমতাও অমোঘ। একবার জাগ্রত হলে কাজ শেষ না করা অবধি তার নিদ্রা নেই।
আমার গা শিরশির করছিল, বললাম, আর যদি কাজ শেষ না করতে পারে? যদি বাধা পায়?
সন্ন্যাসীর চোখ জ্বলে উঠল, বলল, বেতালকে বাধা দেওয়া খুব কঠিন, প্রায় অসম্ভব। কিন্তু বাধা পেলে সে ফিরে এসে যে তাকে জাগিয়েছে, তাকেই হত্যা করে। এসব আগুন নিয়ে খেলা।
সাধু একটু চুপ করে থেকে বলল, আজ রাত্তিরে তোমাকে বেতাল জাগানোর পদ্ধতি দেখাব। তুমি ভয় পাবে না তো?
প্রথমে ভাবলাম বলিয়—হ্যাঁ। তারপর জিনিসপত্র পোটলা করে পালাই। কিন্তু কেমন একটা আকর্ষণ হল, বললাম, না। আপনি কি এরই সাধনা করছিলেন?
সন্ন্যাসী হেসে বললে, তাই।
সেদিন রাত্তির যখন গভীর, সাধু তার ক্রিয়াকর্ম শুরু করল। জবাফুলের মালা, রক্তচন্দন— এসব আগে থেকেই যোগাড় করা ছিল। সাধু সেই নিমকাঠের পুতুলটা এনে তাতে বেশ করে তেল সিঁদুর মাখাল, তারপর সেটাকে কোমর অবধি পুতল মাটিতে। তার চারদিকে বেড়ার মত করে মাটিতে রেখে দিল একটা জবাফুলের মালা। পদ্মাসনে বসে বিড়বিড় করে কি মন্ত্র পড়তে পড়তে পুতুলটায় চন্দনের ছিটে দিতে লাগল। এসব হলে ঝোলা থেকে বের করল একটা মদের বোতল। সাধুর ঝুপড়িতে একটা মড়ার খুলি ছিল আগেই দেখেছি, সেটাতে খানিকটা মদ ঢেলে সাধু আমার দিকে তাকিয়ে বলল, সেই বন্ধ সরাটা কই?
আমি সরা এনে দিলাম। সাধু আটাগুলো নখ দিয়ে খুঁটে খুঁটে তুলে সরাটা খুলল। দেখলাম তিনদিন পোড়ানোতে ভেতরের পাখিটা একদম ছাই হয়ে গিয়েছে। সেই ছাই একচিমটি নিয়ে মদে মেশাল সাধু, তারপর ঢক্ করে মদটা গলায় ঢেলে দিল।
খাওয়ার পরেই সাধুর আশ্চর্য পরিবর্তন দেখলাম। সাধুর চোখ দুটো ছোট ছোট কোটরে গিয়ে যেন দুটুকরো কয়লার মত জ্বলতে লাগল। আমার দিকে ফিরে সাধু বলল, শুকনো কাঠ দিয়ে একটা ধুনি করো—
করলাম। ধুনি বেশ জ্বলে উঠতে সাধু রক্তচন্দন দিয়ে ধুনি পুজো করল। তারপর তামার কোষায় গাওয়া ঘি, একটা জবাফুল, আরো কি যেন মিশিয়ে মন্ত্র পড়ে আগুনে আহুতি দিল। সঙ্গে সঙ্গে একটা বিকট পোড়া গন্ধে ভরে গেল চারদিক। সাধু বিকৃত গলায় হেসে উঠল। আর আমার মনে হল সেই ধোয়া আর অন্ধকারের ভেতরে ধুনির মধ্যে থেকে একটা যেন জমাট অন্ধকার দিয়ে তৈরি মূর্তি উঠে বাতাসে ভর করে ভেসে কোথায় মিলিয়ে গেল। আমি অবাক হয়ে সেইদিকে তাকিয়ে রইলাম। মূর্তিটাকে খুব পরিষ্কারভাবে যে দেখেছিলাম, তা বলতে পারি না। তবে যেটুকু দেখতে পেয়েছিলাম, তাতেই বুক ঠাণ্ডা হয়ে আসে। বিশাল, স্থল রাত্রির অন্ধকার দিয়ে তৈরি যেন একটা অপছায়া।
সাধু বলল, দেখলে? ওই বেতাল—
আমি বললাম, কোথায় গেল ও?
সাধু বসে বলল, এদিকে সরে এস। আমি আসল কথাটা এতদিন তোমাকে বলিনি। আজ বলি। আজ থেকে পনেরো-কুড়িদিন আগে এখান থেকে মাইল কুড়ি দূরে এক গ্রামে আমি মাধব ঘোষ বলে একজন লোকের বাড়ি রাত্তিরে আতিথ্য গ্রহণ করি।
আমার মাথায় বিদ্যুৎ খেলে গেল। মাধব ঘোষ! তাহলে এই কাপালিকই সেদিন মাধব ঘোষের বাড়িতে হাঙ্গামা করেছিল! বটে।