—তবে?
—আপনার মেয়ের শরীরে কয়েকটা দিব্যলক্ষণ রয়েছে। কি লক্ষণ তা আমি বলব না। অন্যের চেয়ে আপনার মেয়ে কিছু আলাদা হবেই। এ আপনি রোধ করতে পারবেন না।
বিজয়বাবু অপ্রসন্নমুখে চুপ করে রইলেন। বুঝলাম আমার ব্যাখ্যা তার ঠিক মনঃপূত হয়নি। তা আর আমি কি করতে পারি? মেয়ের তো কোন অসুখ নেই বা অপদেবতা ভর করেনি যে আমি মাদুলি দিয়ে কি যজ্ঞ করে সারাবার চেষ্টা করব।
এমন সময় ভেতরবাড়িতে একটা হৈচৈ-এর শব্দ শোনা গেল। কয়েকজন মহিলার সম্মিলিত কণ্ঠস্বর। বিজয়বাবু তাড়াতাড়ি করে উঠতে উঠতে বললেন—ওই সুবালা বোধহয় আবার অমন করছে। আসুন ঠাকুরমশায় আমার সঙ্গে, দেখে যান।
সামান্য ইতস্তত করে তার পেছন পেছন বাড়ির ভেতর ঢুকলাম। লম্বা বারান্দা পেরিয়ে একটা ঘরের সামনে দাঁড়া লেন বিজয়বাবু। সে ঘর থেকেই গোলমাল ভেসে আসছে। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ভেতরে উকি দিলাম।
দেয়ালে হেলান দিয়ে মাটিতে বসে আছে সুবালা। চোখ দুটো অর্ধেক বোজা। সেই অবস্থাতেই বিড়বিড় করে কি যেন বলছে। আমাকে দেখে ঘরের মহিলারা ঘোমটা টেনে দিলেন।
বিজয়বাবুকে বললাম—ওঁদের একটু সরে দাঁড়াতে বলুন তো। আমি একবার আপনার মেয়ের কাছে যাব।
বিজয়বাবুকে কিছু বলতে হল না। আমার কথা শুনে মেয়েরা নিজে থেকেই ঘরের এক কোণে সরে গেলেন। আমি গিয়ে হাঁটু গেড়ে সুবালার পাশে বসে ডাকলাম— সুবালা! শুনতে পেল কিনা বোঝা গেল না, অন্তত বাহিরে তার কোনো প্রতিক্রিয়া প্রকাশ পেল না। মনে মনে ইষ্ট স্মরণ করে সুবালার গায়ে হাত বুলিয়ে দিতেই তার কথা বন্ধ হয়ে গেল। যেন সে আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়ছে। জানো তো, মধুসুন্দরী দেবী আমাকে ওই ধরনের কয়েকটি ক্ষমতা দান করেছিলেন। সুবালাও শান্ত হয়ে এল, গভীর নিঃশ্বাস পড়তে লাগল।
আমি মৃদুস্বরে বললাম—বলো মা, কি বলছিলে বলো।
সুবালা টেনে টেনে বলল—খোকা পড়ে যাচ্ছে যে! আমিও পড়ে যাচ্ছি। পেছন থেকে ঠেলে দিল—আমার কোলে খোকা—
বললাম—খোকা কে?
—আমার খোকা।
—তোমার ছেলে?
উত্তর নেই।
—মাথায় কি কষ্ট। উঃ, পাথর এসে লাগল মাথায়।
—কে ধাক্কা দিল তোমাকে?
আর উত্তর নেই। এবারে সত্যিই ঘুমিয়ে পড়েছে মেয়েটি।
বিজয়বাবুকে বললাম—ওকে বিছানায় শুইয়ে দিন। ঘুমিয়ে পড়েছে। আর আপনি আমার সঙ্গে আসুন, কথা আছে।
বাইরের ঘরে এসে বললাম কিছু বুঝতে পারলেন? না, মানে—ঠিক—
—আপনার মেয়ে জাতিস্মর।
—জাতিস্মর!
—হ্যাঁ, সুবালা সম্ভবত আগের জন্মের কথা মনে করতে পারে। যেসব কথাকে। আপনারা অসংলগ্ন বলে মনে করছেন, তা আসলে ওর আগের জন্মে ঘটে যাওয়া ঘটনা। এই কারণেই ওর শরীরে নানা দিব্যলক্ষণ রয়েছে। জাতিস্মর হওয়া আত্মার খুব উঁচু অবস্থার পরিচয়।
বিজয়বাবু বললেন—তাহলে এখন আমাদের কি করা কর্তব্য?
—কিছুই নয়। এ ভাব আপনিই কেটে যাবে। আমি আরও একটি জাতিস্মর মেয়েকে দেখেছিলাম, বয়েস বাড়তে শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে জন্মান্তরের স্মৃতি কমে আসতে থাকে। সুবালার কতদিন এরকম হয়েছে?
বিজয়বাবু একটু ভেবে বললেন—তা প্রায় বছরখানেক হবে।
-তাহলে তো অনেক বেশি বয়েসে শুরু হয়েছে বলতে হবে। জন্মান্তরের স্মৃতি সাধারণত পাঁচ-ছয় বছর বয়েসে জেগে উঠে এই বয়েসে মিলিয়ে আসতে থাকে। যাক, কিছু না করে শুধু দেখে যান। সুবালা আপনিই সেরে যাবে।
সেদিন ফিরে চলে এলাম। তারপর বছর কয়েক ধরে মাঝে মাঝে বিজয় চাটুজ্জের বাড়ি গিয়েছি, কখনো বা উনি আর অমরনাথ আমার কাছে এসে সুবালার খবর দিয়েছেন। মোটের ওপর বলতে গেলে—দু’বছরে আমরা সুবালার গত জন্মে কি ঘটেছিল সে সম্বন্ধে একটা ধারণা করতে পারলাম। বিভিন্ন সময়ে আচ্ছন্ন অবস্থায় সুবালা যা বলেছিল তার ওপরে নির্ভর করেই আমরা কিছু জোড়াতালি দিয়ে সমস্ত ব্যাপারটা আন্দাজ করেছিলাম। কিন্তু আমাদের আন্দাজ যদি সত্য হয়ে থাকে—হয়ে থাকে কেন, নিশ্চয়ই সত্য—কারণ পরে যা ঘটেছিল তাতে আর কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়—তাহলে সে বড় মর্মম্ভদ ঘটনা।
কিশোরী বলল—আপনারা কি আন্দাজ করেছিলেন?
তারানাথ বলল—সুবালা ওই ঘোরলাগা অবস্থায় প্রায়ই বলত সে তার ছেলেকে নিয়ে যেন কোনো উঁচু জায়গা থেকে পড়ে যাচ্ছে! মাথায় আঘাত পাওয়ার কথা বলত। একদিন ও টান করে চুল বেঁধে এসেছে, দেখলাম বাঁদিকের কপালে একটা লম্বা দাগ, পুরনো ক্ষত শুকিয়ে এলেও যেমন দাগ শুকিয়ে যায়—তেমনি। বিজয়বাবুকে বলতে তিনি বললেন ওটা সুবালার জন্মদাগ।
বললাম—খেয়াল করেছেন কি, সুবালা আচ্ছন্ন অবস্থায় মাথার যেখানে আঘাত লাগার কথা বলে, এই দাগটাও ঠিক সেখানেই।
বিজয়বাবু বললেন—তাও কি হয়? গতজন্মের আঘাতের দাগ এজন্মে ফুটে ওঠে?
বললাম—জানি না। তবে পৃথিবীতে অনেক কিছুই যে সম্ভব সে তো দেখতেই পাচ্ছেন। যাক্, দু’বছরে যা জানতে পেরেছিলাম তা খুব স্পষ্ট না হলেও মোটামুটি এই—সুবালা গতজন্মে একটি শিশুসন্তান নিয়ে বিধবা হয়। পরে কে বা কারা কোনো উঁচু স্থান থেকে সম্ভবত কোনো টিলার ওপর থেকে সন্তানসহ সুবালাকে ঠেলে ফেলে দিয়ে হত্যা করে। কিন্তু কেন হত্যা করে, এবং হত্যাকারীর নাম কি—এসব খবর আমরা কিছুতেই জানতে পারিনি। এখানে এসেই সুবালার কথা আটকে যেত! মনের ওপর চাপ পড়লে ক্ষতি হতে পারে ভেবে আমিও জোর করিনি কখনো।
এখানে একটা কথা বলে রাখি। এই ঘটনায় আমি বুঝতে পেরেছিলাম মাতৃস্নেহ কি জিনিস। সস্তানের প্রতি মায়ের টান বিশ্বের একটা বড় শক্তি। সুবালা মাত্র তেরো বছরের কিশোরী— এজন্যে এখনো সে মা হয়নি কিন্তু আধো-অজ্ঞান অবস্থায় যখন সে বলত—খোকা পড়ে যাচ্ছে! খোকাকে বাঁচাও—তখন তার মুখে যে ব্যাকুলতা ফুটে উঠত, তা মাতৃহৃদয়ের গভীর অভিব্যক্তি ছাড়া হয় না। গতজন্মের হারানো ছেলের প্রতি এই আর্তি একটু কমে এল। এইভাবে আরো বছর দুই কেটে যাওয়ার পর আস্তে আস্তে সুবালা অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে এল! এখন তার বয়েস হল সতেরো। একদিন বিকেলে অমরবাবু এসে বললেন—একটা ভালো খবর আছে। বেশ বড় রকমের ভোজ আসন্ন।