আমি বললাম—সত্যি, মেয়েটার দোষ নেই। প্রাণের ভয় সবারই আছে। তাছাড়া চোখের ওপর একটা খুন দেখলে মনের অবস্থা কেমন হয় কে জানে। একজন মানুষকে পাঁচহাতের মধ্যে মেরে ফেলা হচ্ছে—উঃ! ভাবা যায় না।
কিশরী বলল–সত্যি বলেস, খুনের প্রত্যক্ষদর্শীর মনের অবস্থা কি হয় ভারি জানতে ইচ্ছে করে। কিন্তু কে বলতে পারবে?
তারানাথ বলল—আমি পারি। আমি আর কিশোরী তারানাথের কথায় অবাক হয়ে তার দিকে তাকালাম। বলে কি তারানাথ? ঠাট্টা করছে নাকি? কিন্তু সিরিয়াস ব্যাপার নিয়ে ঠাট্টা করবার লোক তো তারানাথ নয়। তাহলে?
কিশোরী আমার চেয়ে আগে সমস্ত পরিস্থিতিকে সামলে নিতে পারে। সে জিজ্ঞাসা করল কি করে বলবেন?
তারানাথ গম্ভীর গলায় বলল—কারণ আমি চোখের সামনে একটা খুন হতে দেখেছি।
তারানাথের কাছে অনেক অদ্ভুত গল্প শুনেছি, কিন্তু এ ব্যাপারে একেবারেই অপ্রত্যাশিত। এবার কিশোরীও কোনো কথা বলল না। তারানাথ আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল—খুন হয়েছিল বটে, কিন্তু সে খুনের জন্য কারো ফাসি হয়নি। আমি ছাড়া আরো কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী ছিল। কেস আদালতে ওঠে, কিন্তু পরে যে খুন করেছিল, সে ছাড়া পেয়ে যায়। শুনবে গল্পটা? তাহলে বলি।
শোনবার জন্য আমাদের অনুরোধ করার সামান্যই প্রয়োজন ছিল। তারানাথ এক কলকে তামাক সেজে বলতে শুরু করল।
বছর দশেক আগের কথা। তখন আমার কাছে অমরনাথ ভট্টাচার্য বলে এক ভদ্রলোক প্রায়ই আসতেন। ব্যক্তিগত একটা বিপর্যয়ে পড়ে আমার কাছে হাত দেখাতে এসেছিলেন। আমার কথামতো রত্ন ধারণ করে সে বিপদ কেটে যায়। তারপর থেকে কৃতজ্ঞতাবশতই হোক আর আমাকে ভাল লেগে যাওয়ার জন্যই হোক, সপ্তাহে অন্তত তিনদিন উনি আড্ডা দিতে আসতেন। অতি অমায়িক মানুষ। আড্ডাবাজ এবং ভালো গল্প বলিয়েও বটে। আমাদের আলাপ খুব জমে উঠেছিল।
একদিন অমরবাবু সন্ধ্যের দিকে এসে হাজির হলেন। দেখলাম উনি কিছু অন্যমনস্ক, কোনো চিন্তায় মগ্ন থাকলে যেমন হয়। চা খাচ্ছেন, হ্যা-হু করে আমার কথার উত্তর দিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু আড্ডা যেন ঠিক জমছে না।
একসময় বলে ফেললাম—আপনার কি হয়েছে বলুন তো? কিছু ভাবছেন?
অমর ভট্টাচার্য একমুহূর্ত কি ভাবলেন, তারপর বললেন—ভেবেছিলাম বলব না। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে বললে আপনাকেই বলা উচিত। অন্যে হেসে উড়িয়ে দেবে কিন্তু আপনি হয়তো বুঝতে পারবেন।
বললাম—খুলে বলুন।
–আমার এক বাল্যবন্ধু আছেন। তার নাম বিজয় চাটুজ্জে। অনেকদিন বিয়ে হয়েছে বটে, কিন্তু একটি বই সস্তান হয়নি। মেয়ে সন্তান—নাম সুবালা। এখন তার বয়েস তেরো। মেয়েটি দেখতে খুব সুন্দরী। পড়াশুনাতেও ভালো। বিজয় প্রাচীনপন্থী গোড়া লোক নয়। মেয়েকে সে লেখাপড়া শিখিয়ে উপযুক্ত করে বিয়ে দিতে চায়। সবই তো ভাল চলছিল, কিন্তু হঠাৎ এক বিপদ উপস্থিত হয়েছে।
–কি হয়েছে?
—সুবালা আজকাল কেমন কেমন সব কথাবার্তা বলতে শুরু করেছে। যার কোনো মানে হয় না এমন সব অসংলগ্ন কথা। বিজয় খুব ভয় পেয়ে গিয়েছে, সে সন্দেহ করছে সুবালার বোধহয় মস্তিষ্কবিকৃতির লক্ষণ দেখা দিয়েছে।
—কি ধরনের অসংলগ্ন কথা? অশ্লীল কিছু?
—আদৌ না। সবার সঙ্গে বসে আলাপ করতে করতে থেমে গিয়ে কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে। তারপর একটা ঘুম ঘুম ভাবের মধ্যে নানা অদ্ভুত কথা বলছে।
—সে কথাগুলো কি?
অমর ভট্টাচার্য বললেন—সে ঠিক বলে বোঝানো যাবে না। আপনি চলুন না একবার। আপনি তো নানা রকম বিষয় জানেন। হয়তো আপনাকে দিয়ে বিজয়ের একটা উপকার হয়ে যাবে। সুবালাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবার আগে আপনি একবার চলুন।
বললাম—বিজয়বাবু কোথায় থাকেন?
–এই কাছেই, অবিনাশ দত্ত লেনে। কাল যাবেন?
আমার কৌতুহল জেগে উঠেছিল, বললাম—বেশ তো, বলে রাখবেন আপনার বন্ধুকে। কাল সন্ধ্যার দিকে যাওয়া যাবে এখন।
-–ঠিক আছে আমি এসে আপনাকে নিয়ে যাব। তৈরি থাকবেন।
পরের দিন গেলাম বিজয় চাটুজ্যের বাড়ি। সাধারণ মধ্যবিত্ত গৃহস্থ, তবে সচ্ছল অবস্থা। ভদ্রলোক বেশ সুপুরুষ। চল্লিশ পেরিয়েও চুলে পাক ধরেনি বা কপালে একটি রেখাও পড়েনি। আমাকে আপ্যায়ন করে বসিয়ে বললেন—বড় বিপদে পড়েছি ঠাকুরমশায়। আমার এই একটি মাত্র সন্তান। ওর যদি কিছু হয় তাহলে আমাদের আর কোনো সাত্বনা থাকবে না। শুনেছেন তো সব অমরের কাছে?
বললাম—মেয়েটিকে একবার ডাকুন না, দেখি।
বিজয়বাবু নিজে গিয়ে হাত ধরে সুবালাকে নিয়ে এলেন। অমর ভট্টাচার্জ ঠিকই বলেছিলেন। মেয়েটি অপরূপ সুন্দরী। বাড়ন্ত গড়নের জন্য সত্যিকার বয়সের চেয়ে অনেক বড় দেখায়। সুবালা ঘরে ঢুকতেই আমি চমকে সোজা হয়ে বসলাম। মেয়েটি সাধারণ মেয়ে নয়। আমাদের তন্ত্রশাস্ত্রে কিছু কিছু অতিলৌকিক দেহলক্ষণের বর্ণনা আছে। সুবালার শরীরে সেগুলি বর্তমান।
আমার চমকে ওঠা বিজয়বাবু লক্ষ্য করেছিলেন, কিন্তু মেয়ের সামনে কিছু জিজ্ঞাসা করলেন না। আমি আদর করে কাছে বসিয়ে সুবালার সঙ্গে কথা বলতে লাগলাম। বেশ স্বাভাবিক মেয়ে, কোন দিক দিয়ে কোন ব্যতিক্রম নেই। কিছু পরে বিজয়বাবুকে বললাম—যান, ওকে ভিতরে দিয়ে আসুন।
বিজয় চাটুজ্জে বললেন, যাও তো মা, ভিতরে গিয়ে মাকে বলো খাবার পাঠাতে।
সুবালা চলে যেতে আমিই প্রথমে বললাম–ভয় নেই বিজয়বাবু, আপনার মেয়ের কোন অসুখ করেনি। এটা পাগলামির পূর্বাভাস নয়।