তার নির্দেশিত দিকে তাকিয়ে দেখলাম সেখানে গাছপালা একটু কম, পাতার ফাঁক দিয়ে রাত্রির আকাশ দেখা যায়। চাঁদ উঠতে আজ দেরি আছে, কিন্তু অস্পষ্ট তারার আলোয় অন্ধকার অনেকটা তরল। বাতাসের ঘূর্ণির সঙ্গে পাক খেয়ে একটা জমাট অন্ধকারের স্তম্ভ আকাশে অনেকখানি ঠেলে উঠেছে। অন্ধকারের উপাদানে তৈরি অমানুষী এক আকৃতি-পরিচিত কিছুর সঙ্গে তার কোনো মিল নেই। সমস্ত পরিবেশ থেকে, চণ্ডিকাপ্রসাদের বাড়ির ওপর থেকে, আমবাগান থেকে বাতাসের সঙ্গে উঠে যাচ্ছে গুড়ো গুড়ো অন্ধকার। কিছুক্ষণের মধ্যেই অন্ধকারের কালো পিণ্ডটা অনেক ওপরে উঠে গিয়ে আবছা হয়ে মিলিয়ে গেল।
তারপরেই বনের বাইরে থেকে ভেসে এল একঝলক বাতাস। বুক ভরে নিঃশ্বাস নেবার মত সহজ, স্বাভাবিক, মুক্ত বাতাস কিটকিট করে নিশাচর কীটপতঙ্গেরা ডাকতে শুরু করল। আমরা কেউ কথা না বললেও বুঝতে পারলাম অমঙ্গলের ছায়াটা একেবারে সরে গিয়েছে। কালীপ্রসাদকেও বয়ে নিয়ে যাবার প্রয়োজন হল না, এর কিছুক্ষণের মধ্যেই তার জ্ঞান ফিরে এল। বাগান থেকে ফেরবার মুখে শেয়ালটা এসে ওঁর সামনে দাঁড়িয়েছিল। ভদ্রলোক স্নায়ুর ওপর এত চাপ সহ্য করতে পারেননি।
ফেরবার সময় চণ্ডিকাপ্রসাদ বললেন—দেখলেন আমার মা কালীর কৌটোর গুণ? সব ব্যাটাকে তাড়িয়ে দিলাম—
বললাম—তা বটে।
তারানাথ থামল। কিশোরী বলল—কিন্তু এ তো মন্ত্রশক্তি বা দ্রব্যগুণের গল্প। এতে বিশ্বাসের শ্রেষ্ঠত্ব কি প্রমাণিত হয়?
তারানাথ বলল—হয়। পরের দিন নির্জনে বসে কালীপ্রসাদের সঙ্গে গল্প করছিলাম। কালীপ্রসাদ বললেন—বাবা বিশ্বাসের জোরে আমাদের আপদ দূর করে দিলেন।
বললাম—কেন, মা কালীর কৌটোর গুণও আছে বলতে হবে—
ম্লান হেসে কালীপ্রসাদ বললেন—দাঁড়ান, একটা জিনিস দেখাই আপনাকে।
একটু পরে হাতে করে মা কালীর কৌটোটা নিয়ে ঘরে ঢুকলেন ভদ্রলোক এবং আমার বিস্মিত দৃষ্টির সামনে ঢাকনাটা খুলে ফেললেন।
বাধা দিয়ে বলে উঠলাম—ও কি করছেন? মন্ত্রপূত নির্মাল্য খুলতে নেই, ওতে গুণ নষ্ট হয়ে যায়।
কিছু না বলে কালীপ্রসাদ বিছানার ওপরে কৌটোটা উপুড় করে ধরলেন। ভিতরে যা ছিল চাদরের ওপর ছড়িয়ে পড়ল।
ভেতর থেকে বেরুল কতকগুলো গোল গোল করে পাকানো খবরের কাগজের গুলি। আর কিছু নেই।
অবাক হয়ে বললাম—এ কি! নির্মাল্য কই?
কালীপ্রসাদ বললেন—নেই।
–তার মানে?
কালীপ্রসাদ মাথা নিচু করে বললেন—মানে আসল কৌটো অনেক দিন আগে। হারিয়ে গিয়েছে। এটা নকল। ছেলের অসুখের সময় কোলকাতায় নিয়ে যাবার পথেই কোথাও পড়ে যায়। বাবা শুনলে অনর্থ করবেন এই ভয়ে শিশিবোতলওয়ালার কাছ থেকে দু’পয়সা দিয়ে এই কোটোটা কিনি। বাবা আজকাল চোখে কম দেখেন, তাকে ঠকানো সহজ। কাজেই বুঝতে পারছেন, যা হয়েছে তা বাবার বিশ্বাসের জোরেই হয়েছে—
—আর কেউ জানে এ কথা?
—শুধু আপনার বৌমা, আমার স্ত্রী। অন্য কেউ না। বাবার বয়েস হয়েছে, আর কদিন বা বাঁচবেন? খামোক কেন তাকে দুঃখ দিই?
তারানাথ থামল। ঘরের মধ্যে স্তব্ধতা। বাইরেও বৃষ্টি ধরে এসেছে। একটা নিঃশ্বাস ফেলে কিশোরী বলল—গল্পটা বেশ। গল্প বানানোয় আপনার একটা স্বাভাবিক দক্ষতা আছে—
সিগারেট ধরাতে গিয়ে তারানাথ জুলন্ত চোখে কিশোরীর দিকে তাকাল।
আমি ব্যাকুল হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে কিশোরীর হাত ধরে টানলাম—ওঠো হে, আবার বৃষ্টি এলে বাড়ি ফেরা মুশকিল হয়ে পড়বে।
০৮. তারানাথের সেদিন কোন কাজ ছিল না
তারানাথের সেদিন কোন কাজ ছিল না। সন্ধ্যের দিকে এমনিতেই তার বৈঠকখানা ফাকা থাকে, আজ যেন বড় ফাকা। তারানাথ বসে একা হুকো খাচ্ছে। আমাদের দেখে খুশী হয়ে বলে উঠল—আরে এস এস, তোমাদের কথাই ভাবছিলাম।
কিশোরী বলল—হঠাৎ আমাদের কথা ভাবছিলেন যে বড়?
—হঠাৎ নয়। আজ সারাদিন কোন কাজ নেই, বুঝলে? অন্য অন্য দিনে কোষ্ঠী করাতে না হোক, অন্তত হাত দেখাতে দু’চারজন এসেই যায়। দিনের খরচাটা যা হোক করে—বুঝলে না? আজ একটা পয়সা আমদানী নেই। হাত-পা কোলে করে বসে থেকে বিরক্তি ধরে যাচ্ছিল। তোমরা আসায় বাঁচলুম।
বললাম—কিন্তু আমরা তো খদের নই।
তারানাথ বলল—না-ই বা হলে। পয়সা না পাই, আড্ডা দিয়ে তো বাঁচব। তোমাদের তো বলেইছি, পয়সা কম উপার্জন করিনি জীবনে। বৈষয়িক লোক হলে অনেক জমিয়ে ফেলতে পারতাম। পয়সার মায়া নেই আমার। দিন চলে গেলেই খুশি। যাবার সময় কটা পয়সা গাটে বেঁধে নিয়ে যেতে পারব মনে কর?
চারি পেয়ালায় চা নিয়ে এল। তারানাথ পাকা মজলিশী লোক। চা খেতে খেতে সে গল্প জমিয়ে তুলল। কিছুক্ষণ নানা বিষয়ে কথা হবার পর কিশোরী বলল—ভালো কথা, আজকের কাগজ দেখেছেন? তরুবালা হত্যাকাণ্ডের মীমাংসা হয়ে গিয়েছে। প্রত্যক্ষদশীর বিবরণ অনুযায়ী ফাঁসির হুকুমও হয়ে গিয়েছে দেখলাম।
খবরটা দেখেছি বটে। কিছুদিন আগে কোলকাতার এক কুখ্যাত পাড়ায় তরুবালা নামে একটি পতিতা মেয়ে খুন হয়। খুনী কোন সূত্র রেখে যায়নি। তাই নিয়ে ক’দিন কাগজে খুব হৈ চৈ চলেছিল। আজ কাগজে বেরিয়েছে খুনী ধরা পড়ার খবর! অপর একটি পতিতা মেয়ে বাথরুমে লুকিয়ে থেকে সমস্ত খুনের দৃশ্যটা দেখেছিল। এতদিন প্রাণের ভয়ে কিছু বলেনি। কিন্তু পুলিশী জেরার চাপে আর বিবেকের তাড়নায় সে শেষপর্যন্ত সব স্বীকার করেছে। বস্তুত তার বিবৃতিকে নির্ভর করেই অপরাধীর শাস্তি হয়ে গেল।