দুপুরে সুন্দর দিবানিদ্রা দিয়ে যখন উঠলাম, তখন বিকেলের রোদ মিলিয়ে গিয়ে ছায়া গাঢ় হয়ে এসেছে। বাইরের তক্তাপোশে বসে চণ্ডিকাপ্রসাদ হুঁকোয় টান দিচ্ছিলেন, সেখানে গিয়ে বসলাম। গড় হাতে কালীপ্রসাদ উঠোন পেরিয়ে বাড়ির বাইরে বাগানের দিকে চলে গেলেন। চণ্ডিকাপ্রসাদ ডেকে বললেন—কালী, চট করে সেরে আয়। একসঙ্গে বসে ঠাকুরমশায়ের যজ্ঞের ফর্দটা করে ফেলা দরকার।
এই আসছি—বলে কালীপ্রসাদ বেরিয়ে গেলেন।
সকালের আলোচনার খেই ধরে চণ্ডিকাপ্রসাদ বললেন হ্যাঁ, সকালে যে কথা হচ্ছিল—নিষ্ঠা এবং সদগুরুর প্রয়োজন আছে ঠিকই, কিন্তু মস্ত্রোচ্চারণের যথার্থতার ওপরেই অনুষ্ঠানের সাফল্য নির্ভর করে। মন্ত্রের প্রত্যেক অক্ষরের একজন অধিষ্ঠাত্রী দেবী আছেন, সঠিক উচ্চারণ না হলে তারা কুপিত হন—
বাড়ির ভেতর থেকে গরম ভাজা পরোটা আর আলুভাজা এল। খেতে খেতে গল্প। চলল। যখন সন্ধ্যে উতরে অন্ধকার বেশ ঘন হয়ে উঠেছে, সে সময় অভিরাম এসে জিজ্ঞাসা করল—কত্তামশাই, ছোটবাবু কোথায়? মাঠাকরুণ ডাকছেন—
চণ্ডিকাপ্রসাদ বললেন—কে, কালী তো-তাই তো, কালী ফেরেনি? সে কি!
হঠাৎ আমারও খেয়াল হল, কালীপ্রসাদ বহুক্ষণ হল বাগানে গিয়েছেন বটে। ছোট-বড় কোনো প্রাকৃতিক আহানে সাড়া দিতেই এতক্ষণ লাগতে পারে না।
দু’এক মুহূর্তের ভেতর ব্যাপারটা সম্যক উপলব্ধি করে আমরা লাফিয়ে উঠলাম। চণ্ডিকাপ্রসাদ কেমন অবরুদ্ধ গলায় বললেন—অভিরাম, আলো আর লাঠি নিয়ে আয়, তাড়াতাড়ি।
বাড়ি থেকে বেরুচ্ছি, চণ্ডিকাপ্রসাদ বললেন—ঐ যাঃ, দাঁড়ান—এক্ষুনি আসছি।
তিনি আবার বাড়ির মধ্যে ঢুকে গেলেন। মিনিটখানেক বাদে বেরিয়ে এলে বুঝলাম আমার আন্দাজ ঠিকই ছিল—তার হাতে মা-কালীর কৌটো। এইটে আনতেই তিনি ফিরে গিয়েছিলেন।
আমবাগানে পা দিয়েই বুঝতে পারলাম এ বাড়ির ওপর থেকে দুর্ভাগ্যের কালো ছায়া একেবারে মিলিয়ে যায়নি। সমস্ত পরিবেশে ছেয়ে আছে একটা বিকট গন্ধ, গতকাল এসে যেটা পেয়েছিলাম। বিকেলবেলা মনের মধ্যে যে প্রসন্নতা জেগে উঠেছিল, তা কোথায় বিলীন হয়ে গেল।
লণ্ঠন হাতে অভিরাম আগে আগে চলেছে, সে ডাকছে—ছোটবাবু গো-ও-ও—
চণ্ডিকাপ্রসাদ ডাকছেন—কালী-ই-ই—
আমার বুক গুরগুর করছে। আজ সন্ধ্যেটা ভাল নয়—ভাল নয়।
একটা ঝোপের পেছনে উপুড় হয়ে পড়ে থাকা কালীপ্রসাদকে অভিরামই আগে দেখতে পেল! ‘ছোটবাবু’ বলে চিৎকার করে উঠে সে ছুটে গিয়ে কালীপ্রসাদের দেহের পাশে হাটু গেড়ে বসে কেঁদে উঠল।
পরমুহূর্তেই আমরাও পৌঁছে গেলাম। আমি শক্ত করে চণ্ডিকাপ্রসাদের হাত ধরে রেখেছি, বুঝতে পারছি তার সমস্ত শরীর ঠকঠক করে কাঁপছে। এ অবস্থায় সেটাই স্বাভাবিক। তার হাত ছেড়ে দিয়ে বললাম—দাঁড়ান একটু, এত বিচলিত হবেন না—
নিচু হয়ে কালীপ্রসাদের নাড়ি দেখলাম, বুকে হাত দিয়ে স্পন্দন বোঝার চেষ্টা করলাম। নাড়ি ঠিক আছে, তবে মৃদু। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললাম—ভয় নেই, ইনি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছেন। অভিরাম, চল-ধরাধরি করে একে বাড়ি নিয়ে যাই।
আমরা অজ্ঞান কালীপ্রসাদের দেহ তোলবার জন্য নিচু হয়েছি, হঠাৎ ঠিক গতকালের মত ঝোপের মধ্যে খস খস শব্দ হল। কি যেন আমাদের দিকে আসছে। কিন্তু তার গতি কালকের চেয়ে ধীর।
আমাদের ভয়চকিত দৃষ্টির সামনে ঝোপ ঠেলে বেরিয়ে এল একটা শেয়াল! গতকাল যে শেয়ালটাকে অভিরাম মেরেছিল! প্রাণীটার মাথা দুফাক হয়ে আছে, ঘিলু বেরিয়ে গড়াচ্ছে ডান চোখের ওপর দিয়ে। অন্য চোখে মৃত, নিষ্প্রাণ দৃষ্টি। প্রকট দংষ্ট্রার ফাঁক দিয়ে জিভের আধখানা বেরিয়ে রয়েছে। সে এক অনৈসর্গিক, বীভৎস দৃশ্য!
ধীর, কিন্তু অমোঘ গতিতে শেয়ালটা আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। কোনোদিকে কোনো শব্দ নেই, গাছের পাতায় বাতাসের সামান্যতম মর্মর নেই—সমস্ত জগৎটাই অন্ধকারের চাদরে ঢাকা পড়ে আড়াল হয়ে গিয়েছে চেতনার থেকে। থাকবার মধ্যে কেবল সামনে ওই সচল মৃতদেহটা।
হঠাৎ অনুভব করলাম আমার পাশে চণ্ডিকাপ্রসাদের নিঃশ্বাস দ্রুত হয়ে উঠেছে। তাকিয়ে দেখলাম তার বার্ধক্যে স্তিমিত চোখে কি এক আগুনে জ্বলছে। মুখের ভঙ্গিতে ভয় নেই, আছে প্রবল ক্রোধ। ত্বরিতে মা কালীর কৌটো হাতে নিয়ে সামনে ঝুঁকে পড়ে কৌটোটা বাড়িয়ে ধরে বললেন—থাম!
সচল মৃতদেহ স্থাণু হয়ে গেল।
আবার সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে কৌটোসুদ্ধ হাত মাথার ওপর তুলে চিৎকার করে চণ্ডিকাপ্রসাদ বললেন—মা কালীর নামে বলছি, আমার বাড়ির সব বিপদ দূর হয়ে যাক যদি সদ্ধর্ম নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে থাকি, যদি সৎ কায়স্থের সন্তান হই, যদি জীবনে কোনো পুণ্যসঞ্চয় করে থাকি—তার সবটুকুর জোরে আদেশ করছি, যে অপদেবতারা আমার বাড়িতে ভর করেছে তারা এই মুহূর্তে দূর হয়ে যাক। আমার হাতে পবিত্র নির্মাল্যের এই কৌটো রয়েছে। দেখি তাদের কত শক্তি, সাধ্য থাকে আমার ক্ষতি করো—
মাথার ওপরে কৌটো তুলে ধরে তিনি বিভিন্ন দিকে ঘোরাতে লাগলেন।
শেয়ালের মৃতদেহটা আস্তে আস্তে আবার কাত হয়ে পড়ে গেল। এবারে সেটা সত্যিই মরেছে।
তার সঙ্গে সঙ্গে একটা অদ্ভুত ব্যাপার হল।
এতক্ষণ বন ছিল, নিম্পন্দ, নীরব। হঠাৎ কোথা থেকে ছুটে এল ঝড়ের মত বাতাস। সারা বাগান, ঝোপঝাড় মথিত করে কিছুক্ষণ সে বাতাস বইল। অভিরাম বলে উঠল—দেখুন ঠাকুরমশায় দেখুন।